Sunday, September 5, 2021

মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী: স্মৃতিকথন

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই দিনেই মা আমাদের ছেড়ে চলে যান। মা'কে নিয়ে কোনো লেখাই আমার পক্ষে যথেষ্ঠ নয়। তবুও এই এক বছর ধরে নানা এলোমেলো স্মৃতি, কথা ও ঘটনা প্রতিনিয়ত মনের মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মেরে গেছে। সেই সব অবিন্যস্ত স্মৃতি বা ঘটনাগুলোকেই আজ ধরবার চেষ্টা করেছি।

নিম্নবিত্ত পরিবারের মহিলাদের জীবনের ছবি বোধহয় একটিমাত্র শব্দেই আবদ্ধ থাকে - সেটা লড়াই। মায়ের জীবন কে ব্যাখ্যা করতে গেলেও ওই একটা শব্দই বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে মনে - লড়াই বা সংগ্রাম।
হুগলি জেলার শেওড়াফুলি শহরে ১৯৪৬ সালের ৩১শে জুলাই মায়ের জন্ম হয়। সাড়ে তিন বছর বয়সে দাদু (মায়ের বাবা) সপরিবার চলে আসেন কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের পদ্মপুকুর লেনে। সেখানে ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু। এর প্রায় মাস ছয়েক পরে অর্থাৎ মায়ের বয়স যখন চার বছরের কাছাকাছি, দাদু হঠাৎই মারা যান। পাঁচ বোন ও তিন ভাই কে নিয়ে দিদিমা'র (মায়ের মা কে আমি দিদিমা বলেই ডাকতাম) তখন মাথায় হাত। একমাত্র আমার বড়মাসিমনীরই তখন বিয়ে হয়েছিলো। দাদু মারা যাওয়ার পর আরো প্রায় এক বছর ভবানীপুরেই মায়েরা থেকেছে। তারপর যাদবপুরে মায়ের এক কাকার বাড়িতে ছেলে মেয়ে নিয়ে এসে ওঠেন আমার দিদিমা। সেখানে বেশ কিছুদিন থাকার পর যাদবপুরেই কিছুদিন ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন এবং আমার বড়মামা চাকরি পাওয়ার পর যাদবপুরে নিজেদের বাড়ি করে উঠে আসেন।
খুব অল্প বয়সেই মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেলে নিজেকেই নিজের সাথে যুঝতে হয়। মায়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। আড়ম্বরহীন, অস্বচ্ছল অবস্থায় পিঠোপিঠি ভাই বোনেদের একসাথে বড় হয়ে ওঠার লড়াই। সাথে ছেলে মেয়েদের ন্যূনতম শিক্ষিত করে তোলার জন্যে দিদিমা'র অদম্য প্রয়াস ও খাটুনি। আর ছিল আমার বড়মাসিমনীর নীরব অবদান ও বড়মামার আত্মত্যাগ (sacrifice)। ভাই বোনদের মধ্যে মায়ের পর আর একটাই ভাই। ছোট হওয়ার সুবাদে মায়ের কপালে স্নেহ ও আদরের পরিমাণ অন্য ভাই বোনদের চেয়ে একটু বেশীই জুটেছিল। মায়ের পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করত বলেও শুনেছি। বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও মা পড়াশোনাটা চালিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। প্রি-ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় থেকেই মায়ের টিউশন করা শুরু। সাংসারিক কাজকর্ম ও টিউশন পড়িয়েও প্রধানত আমার বড়মাসিমনী ও বড়মেশোমশায়ের উৎসাহে ও বড়মামার সহযোগিতায় ১৯৬৭ সালে মা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হ'ন। তারপর ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (২৪শে মাঘ) মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের এক একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ হিসেবে মায়ের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু।
বিয়ের পর অন্য এক লড়াই শুরু। এক কালের নায়েব পরিবারের অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল অবস্থা তখন পড়তির দিকে কিন্তু বিলাসিতার ঠাঁটবাট তখনও পুরোটা যায় নি। ভাসুর, দেওর, জা ও তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তখন পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ১১ জন। পরে আরো বাড়ে। এছাড়া আগেকার দিনের নিয়মমতো আত্মীয় স্বজনদের নিয়মিত আসা, যাওয়া ও থাকা। ১৯৬৬ সালে আমার ঠাকুর্দা (বাবার বাবা) মারা যান। সম্ভবত ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকেই আমার বাবা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পদস্থ চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চাকরি টি ছেড়ে দেয়। কলকাতা থেকে বর্ধমানের একটি গ্রামে বাবা কে বদলি করে দেওয়াতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে বাবা'র মতবিরোধ ও কাউকে না জানিয়ে চাকরি ছাড়ার নিজস্ব সিদ্ধান্ত! অতঃপর কলকাতার পাট চুকিয়ে বাবা'র দেশের বাড়িতে অর্থাৎ বহরমপুরে প্রত্যাবর্তন। বিয়ের পরে একান্নবর্তী পরিবারে বাবা'র তখন রোজগারপাতি কম ও মফস্বল শহরের এক অখ্যাত পাড়ার একটি অতি সাধারণ পরিবারে "কলকাতার মেয়ের" গৃহবধূ হয়ে এসে পাঁচটার সংসারে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ের সেই শুরু। নতুন মুখ, নতুন পরিবেশ, নতুন আদবকায়দা, নতুন রকম কথাবার্তায় মানিয়ে নেওয়ার অচেনা আপোষ সময়ের সাথে ধীরে ধীরে একদিন চেনা হয়ে যেতে শুরু করে। মনের কথা বলার লোক বলতে তখন দুজন - বাবা আর আমার কাকা অর্থাৎ মায়ের দেওর। পাড়ার ছেলে মেয়েদের টিউশন পড়ানো শুরু করেছে মা তখন।
একান্নবর্তী পরিবারগুলোর বাঁধন তখন আলগা হতে শুরু করেছে। ১৯৭২ সালের কোনো একদিন বাবা - মা'র অনুপস্থিতিতেই ১২৬ নম্বর ডেভিস রোডের বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল! কলকাতা থেকে ফিরে বাবা - মা জানতে পারল একটি সংসার ভেঙে তখন তিনটে আলাদা আলাদা সংসার (একই বাড়িতে) হয়ে গেছে। দিদি বা আমি তখনও পৃথিবীর আলো দেখিনি। হাঁড়ি আলাদা হলেও মনের বাঁধন আলাদা হয় নি।
দিদি বা আমি হওয়ার সময়ও মায়ের অন্যরকম লড়াই। ডাক্তারের পরামর্শে অনেক ধরনের ওষুধ ও সাবধানতা অবলম্বনের পর দিদি ও আমি দুজনেই বিলম্বিত সন্তান। আমি ছিলাম শুধু সেই বাড়িরই না, বংশেরও কনিষ্ঠতম সন্তান (এখন অবশ্য আমার পুত্র)। জেঠঠুতো, খুড়তুতো মিলিয়ে তখন বাড়িতে মোট নয় ভাইবোন। সবথেকে ছোট ও সবচেয়ে বড়'র ব্যবধান প্রায় পঁচিশ বছর। বাবা কোনদিনই বৈষয়িক বা খুব সাংসারিক ছিলেন না। আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো থেকে পড়ানো, পার্কে নিয়ে যাওয়া, কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি সবই মায়ের হাত ধরে। একই বাড়িতে একসাথে বড় হওয়ার যেমন সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও থাকে অনেক রকম। তার মধ্যেও দিদিকে আর আমাকে কড়া শাসনে, অন্যদের অগ্রাহ্য করে ঘরের মধ্যে বসিয়ে নিয়মিত পড়ানো, স্কুলের খাতা পরীক্ষা (check) করা, পড়া ধরা ও লেখানো, শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে গিয়ে আমাদের পড়াশোনার খবর নেওয়া, পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও রেফারেন্স বই জোগাড় করা বা প্রয়োজনে কেনা, আঁকা বা আবৃত্তি শেখাতে নিয়ে যাওয়া - এসব করার জন্য সাহস ও মনের জোর লাগে। এছাড়াও দুবেলা রান্না করা (ফ্রিজ থাকার কোনো প্রশ্নই ছিল না), অন্যান্য সাংসারিক কাজ, বংশানুক্রমে চলে আসা নানারকম উপাচার এসবতো ছিলই। মা - বাবা নিজেদের শখ আহ্লাদের সাথে সারাজীবন আপোষ করলেও আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে কখনোই এবং কারোর সাথে আপোষ করেনি। যে পরিবেশ ও যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা বড় হয়েছি সেই প্রেক্ষিতে বিচার করলে মায়ের এই লড়াই ভীষণই কঠিন ছিল। বাবা - মা'র ৩৭ বছরের বিবাহিত জীবনে বাবা মা বা আমরা কোথাও কোনোদিন বেড়াতে যাইনি, যাকে ছুটি বা অবকাশ যাপন বলে। যাওয়ার মধ্যে মূলতঃ ছিল কালনা (বড় পিসীর বাড়ি), যাদবপুর (মামার বাড়ি), কৃষ্ণনগর (দুই মাসিমনীর বাড়ি), সোদপুর (ছোট পিসীর বাড়ি) ও কলকাতা সংলগ্ন আরো কিছু আত্মীয় স্বজনের বাড়ি। তবে বেড়ানোর থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের তাগিদেই সেসব জায়গায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ও কারোর বিয়ে থাকলে যাওয়া হতো। অনেক সময় বাবা যেতেও পারতো না - মা, দিদিকে আর আমাকে নিয়ে যেতো। বাবা হয়তো গিয়ে নিয়ে আসতো। এ ভাবেই "মা - ন্যাওটা" এক মফস্বলের ছেলের শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পা দেওয়া।
আমার উচ্চমাধ্যমিকের সময় দিদি এম. এস. সি পড়তে কলকাতায় চলে গেলো। আমি উচ্চমাধ্যমিকের পাশ করার পর বাবা প্রথম একটা সতেরো ইঞ্চির সাদাকালো টিভি কিনেছিলো। সময় বহমান। ২০০০ সালে আমি এম. এস. সি পড়তে কলকাতা চলে যাই আর দিদি তখন স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করে অন্য একটি শহরে শিক্ষিকা। তখনই মায়ের প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে আর বাবার তো উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিলই। ২০০৩ সালে বিয়ের পর দিদি বিদেশ চলে যায়। আমিও বাড়ির বাইরে কলকাতায়। জেঠঠুতো, খুড়তুতো দিদিদের সবারই বিয়ে হয়ে তখন এক একজন এক এক জায়গায়। আর কাকার ছেলেও তখন চাকরি সূত্রে কলকাতায়। জেঠু মারা যান আমি যখন ক্লাস সেভেন। একদা একান্নবর্তী পরিবারের "সাড়ে আট কাঠা জমির ওপর দালান দেওয়া বাড়ি" তে তখন মাত্র পাঁচজন বয়স্ক মানুষ - বমা (জেঠিমা কে আমি বমা বলে ডাকতাম), বাবা, মা, কাকা, কাকী। সবারই নিজস্ব শারীরিক সমস্যা। কে আর কাকে দেখবে! ২০০৪ সালে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে এসে দু দিনের মধ্যে মা কে পেসমেকার বসানোর নির্দেশ ডাক্তারের। মায়ের শরীর তারপর থেকেই ভাঙতে থাকে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আমার তখন পি এইচ ডি 'র প্রথম দিক। বাবা মারা যাওয়ার দিনটাও ছিল ২৪শে মাঘ অর্থাৎ যেদিন বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিলো।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই সাহসী, ডাকাবুকো মা একদম পাল্টে যেতে থাকলো। জীবনে কারোর কারোর উপস্থিতিটাই অনেকসময় শুধু অর্থবহ হয়। ২০০৮ সালে সেপটিসিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতার এক নার্সিংহোমে ২২ দিন ভর্তি থাকার পর মা যখন ছাড়া পেলো, তখন খুবই দুর্বল ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বহরমপুর বাড়িতে থাকা মায়ের পক্ষে বাস্তবিকই আর সম্ভব ছিল না। কলকাতায় এক বন্ধুর মেসে প্রায় এক মাস মাকে নিয়ে থাকলাম। আমার তখন পি এইচ ডি চলছে। সেমিনার, কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি তে অন্য শহরে বা দেশে যেতে হতো। আর মায়ের পক্ষে কোথাওই একা থাকা সম্ভব ছিল না। দিদির কাছে পাকাপাকি ভাবে থাকতে মা রাজি ছিল না। শুধুমাত্র আমার কথা ভেবে সমস্ত সামাজিক বাঁধা ও সংস্কার (taboo) কে নস্যাৎ করে মা কলকাতায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে সম্মত হলো। ২০০৮ সালে কলকাতায় প্রথম হেল্পএজ ইন্ডিয়ার (HelpAge India) একটি আশ্রমে মা থাকা শুরু করলেন। মা ছিলেন সেখানকার প্রথম আবাসিক। রীতিমত সাক্ষাৎকার (interview) দিয়ে থাকার সুযোগ পেয়েছিলো। স্নাতক ডিগ্রি টা প্রথম কাজে লেগেছিল!
মায়ের জীবনের সবচেয়ে আরামের দিনগুলো ছিল সেই বৃদ্ধাশ্রমের দিনগুলো। জীবনের অপূর্ন ইচ্ছেগুলো পূরণ করার সব রকমের সুযোগ পেয়েছিলো মা ওই বৃদ্ধাশ্রম থেকেই। যেমন গান করা, ছবি আঁকা, হাতের কাজ, অল্পসল্প লেখালেখি, বেড়ানো ও আরো অনেককিছু। সম্ভবত সে কারণেই মা ওই জায়গাটি ছেড়ে দিতে কোনোভাবেই আর রাজী ছিল না। ইতিমধ্যে দিদি হায়দরাবাদে সেটেলড্ আর ২০১০ সালের শেষের দিকে আমার বিয়ে হল। বিয়ে অবশ্য বহরমপুর বাড়ি থেকেই হয়েছিলো। মা মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কলকাতায় থাকতো, কখনো দিদির কাছে আবার কখনো বা বহরমপুরে কিছুদিনের জন্য যেতো। ইতিমধ্যে ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, প্রেশার ছাড়াও মায়ের হজমের সমস্যা, ভার্টিগো ও ইউটিআই - এর সমস্যা শুরু হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি পেয়ে আমি পুণায় চলে আসি। তখন আমার পুত্রের বয়স তিন মাস। স্ত্রী পুত্র তখন কলকাতাতেই থাকতো। আমি বা দিদি কেউই কলকাতায় না থাকলে মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকাটা ঠিক হবে না বলেই আমাদের মনে হয়েছিলো। কারণ সব থেকে বড় সমস্যা চিকিৎসাজনিত। তাই সেই বৃদ্ধাশ্রমটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। আমার পুণের চাকরিতে যোগদানের প্রথম আটমাস মা দিদির কাছে হায়দরাবাদে ছিল। আর তারপর থেকে পুণেতে আমাদের সাথেই। ততদিনে আমার স্ত্রীপুত্রও পুণে চলে আসে।
পুণে তে ছেলে - বৌমা - নাতির সাথে থাকার একটা সুখানুভূতি হয়তো ছিলো। কিন্তু যেটা ছিল না সেটা হল কথা বলার লোক। আর সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশ যেখানে বাংলায় কথা বলার কেউ নেই। নেই সমবয়স্ক ও সমমনস্ক কেউ। আমি অফিসে চলে যেতাম, আমার স্ত্রীও কলেজে চলে যেতো। নাতি কে নিয়ে আর টিভি দেখে সারাদিন কাটে। শারীরিক অসুস্থতার সাথে লড়াই করতে করতে মা তখন ক্লান্ত। দু দুবার দুটো পা ভেঙে দুবার ভারী সার্জারি। প্রায়ই ইউটিআই। দিনের পর দিন ওষুধের সংখ্যা বেড়ে চলেছে - সাথে রোজ ইনসুলিন তো আছেই। একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি। মনমেজাজটাই ভেঙে গিয়েছিলো। নাতির সাথে দৌড়ঝাঁপ করার শারীরিক সক্ষমতাও আর নেই। সেই ছোটো বয়স থেকেই তো সংসারের চাপ! তারপর বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে দেওয়ার একটা আফসোস তো ছিলই।
শেষবার পা ভাঙল গতবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। পেসমেকার পাল্টানোর কথা ছিল, তার আগেই স্নান করার সময় পড়ে গিয়ে পা ভাঙল। হাসপাতালে পায়ের সার্জারি হওয়ার পর যখন ছাড়া পেলো, তখন করোনা অতিমারী শুরু হয়ে গেছে। যখন শরীরটা একটু ভালোর দিকে, তখন ইউটিআই শুরু হলো আবার। ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করলো। শেষ সার্জারির ধকল আর নিতে পারলো না। গত বছর পাঁচই সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সেরিব্রাল অ্যাটাক হল। করোনা অতিমারীর ভয়ঙ্কর অবস্থায় পুণের কোনো হাসপাতাল, নার্সিংহোমেই তখন কোনো শয্যা খালি নেই। পরিচিত ডাক্তারবাবুরাও অসহায় অবস্থায় তাঁদের অক্ষমতা জানিয়ে দিলেন। আমার সরকারি চাকরির কোনো সুবিধেই কোনো কাজে এলো না। এমন কি একটা অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া গেলো না। মা তখন প্রায় - অচেতন। শেষ অবধি আমার নিজের গাড়িতেই কয়েকজন সহকর্মীর সাহায্যে ও একজন সহকর্মীর ব্যক্তিগত প্রভাবে একটা মাঝারি মানের হাসপাতালে মা'কে নিয়ে যেতে পারলাম। সেখানে ডাক্তার দেখার পর বাড়ি নিয়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সে সময় মায়ের যে সাপোর্ট সিস্টেম দরকার ছিল, সেটি ওই হাসপাতালে নেই এবং আরো জানালেন, যে সব হাসপাতালে সেই সাপোর্ট সিস্টেম আছে সেগুলোর কোথাওই একটুও জায়গা নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে আরো ছোটো একটি নার্সিংহোমে গেলাম। সেখানেও ডাক্তার একই কথা বললেন। সাথে জুড়লেন, বড় নার্সিংহোমে জায়গা পেলেও মা করোনা আক্রান্ত হবে এবং তাতে আমাদের সমস্যা আরো বাড়বে!
মা কে নিয়ে যখন ফিরে এলাম তখন ঘড়ি তে প্রায় দুপুর দেড়টা। বাহুল্য বর্জিত তিন কামড়ার এক সরকারি আবাসনের একটি ঘরে বসে আমি তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়, আমার পুত্র অন্য একটি ঘরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে বসে আছে, মায়ের পরিচারিকা তখন ডাইনিং রুমে দুপুরের খাবার খাচ্ছে আর আমার সহধর্মিণী, আমার এক সহকর্মী এবং আমার বিভাগীয় প্রধান ও ওঁনার স্ত্রী মায়ের ঘরে বসে মায়ের শেষ লড়াইয়ের সাক্ষী। দিদি তখন হায়দরাবাদে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে। হুঁশ ফিরল আড়াই টা নাগাদ যখন আমার সহকর্মী আমায় বললো "সুমন, তুমহারা মাতাজী শায়দ ঔর নেহি হ্যায়"। সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার আর এক সহকর্মীর ডাক্তার-পত্নী এসে আনুষ্ঠানিক মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করলেন ও বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমার অফিসের সরকারি ডাক্তারবাবু এসে ঔপচারিক মৃত্যু-শংসাপত্র আমাকে দিয়ে গেলেন।

শিক্ষক দিবসের দিনেই হারালাম আমার জীবনের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক আমার মা কে। মায়ের আঁচলের হলুদের গন্ধে বড় হওয়া এক অতি সাধারণ মফস্বলের ছেলে কে আজকের মেট্রোপলিটান তৈরী করতে মায়ের সময় লেগেছিল ৪৩ বছর। আর এই ৪৩ বছরের নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়েছিল মাত্র একটা মুহুর্তে - যে মুহুর্তের একটা দিকে 'মা আছে', অন্য দিকে 'মা ছিল'।

নীচে পাঁচটি ছবি দিলাম। ১: মায়ের কলেজ জীবনের তৃতীয় বর্ষের ছবি। ২: মায়ের গানের ডায়েরির একটি পাতা। নিজের হাতের লেখায় গীতবিতানের একটি গান। ৩: কলকাতায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকাকালীন বিভিন্ন মুহূর্তের কোলাজ। ৪: আমার পুত্রের জন্য একটি খাতায় মা নিজের হাতে অনেকগুলি ছড়া লিখেছিল, যেগুলি আমরাও ছোটবেলায় পড়েছি। সব ছড়াগুলোই মা স্মৃতি থেকে লিখেছিল। সেই খাতারই একটা পাতার ছবি। ৫: শেষবার ২০১৯ সালের অক্টোবরে দমদমে বড় মাসিমনীর বাড়ি তে ভাইফোঁটার দিন। ছবি তে মা, আমার দুই মামা (বড় ও ছোট) ও দুই মাসিমনী (বড় ও সেজো)।

সুমন সিনহা
০৫/০৯/২০২১







এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...