Monday, July 4, 2022

বিদায় বেলায়

"... যতো বড় হও,
তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও।
'আমি মৃত্যু - চেয়ে বড়' এই শেষ কথা ব'লে
যাব আমি চলে।।"

আপনার চলে যাওয়ার ভার বহন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আজ। কিন্তু যে সৃষ্টি, যে আদর্শ, যে ভাবনা, যে দৃষ্টান্ত আপনি রেখে গেলেন, তা যেনো বাঙালি জাতির কাছে, ভাবী প্রজন্মের কাছে আগামীর বার্তা হয়ে থাকতে পারে।
অধুনা বাংলাদেশের বগুড়া জেলায় ১৯৩১ সালের ৮ই জানুয়ারি তরুণ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা ওখান থেকেই। পরবর্তীকালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (স্কটিশচার্চ কলেজ) থেকে রসায়নবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা। কিন্তু ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিনেমার জগৎ। ২৮ বছর বয়সেই চিত্র পরিচালনায় প্রবেশ। প্রথম ছবি উত্তম - সুচিত্রা অভিনীত 'চাওয়া পাওয়া' (১৯৫৯)। সাড়া ফেলে দেওয়া চলচ্চিত্র দিয়ে সেই শুরু। বানিজ্যিক ছবির মধ্যেও যে রুচি, মনন ও বোধের স্বাক্ষর রাখা যায়, তা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। হাস্যরস ও নির্মল আনন্দ দর্শকদের উপরিপাওনা ছিল। আর ছিল সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ প্রয়োগ। প্রতিটি সিনেমার মধ্যে দিয়ে উনি মানুষের কথা, জীবনের কথা, যাপনের কথা সাবলীল ভাবে স্বচ্ছন্দে বলে গেছেন অথচ বিষয় বৈচিত্র্যে প্রতিটি ছবিই স্বতন্ত্র। এখানেই ওঁর নিজস্বতা, স্বকীয়তা - নিজেই তৈরী করেছেন সিনেমার নিজস্ব ব্যাকরণ, নান্দনিকতায় যার ঘাটতি পড়েনি কখনো। শুধু শিল্পই সৃষ্টি করেননি তিনি - গড়েছেন একাধিক শিল্পী। রুমকি রায় কে কেউ মনে রাখেনি আজ, মনে রেখেছে দেবশ্রী রায় কে। 'দাদার কীর্তি' চিনিয়েছে তাপস পাল কে। 'বালিকা বধূ' উপহার দিয়েছে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় কে। 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' দেখে যে উচ্চাঙ্গের হাস্যরস ও অনাবিল আনন্দ বাঙালি দর্শকরা পেয়েছে, তার জুড়ি মেলা ভার। এরকম একের পর এক অবিস্মরনীয় সিনেমার নাম লিখে কলেবর বড় করাই যায় কিন্তু সেটা লিখে শ্রদ্ধা জানাবার উদ্দেশ্য আমার নয়। সারাজীবন নিজের কাজের প্রতি থেকেছেন অসম্ভব সৎ। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন পদ্মশ্রী (১৯৯০), চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি BFJA পুরস্কার, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একবার আনন্দলোক পুরস্কার। কখনো আপোষ করার প্রয়োজন পড়েনি - না কর্মজীবনে না ব্যক্তিজীবনে। শুনেছি 'পলাতক' সিনেমার জন্য উনি যখন অনুপ কুমার কে নায়কের চরিত্রে নির্বাচন করেন, তখন কলকাতার সমস্ত নামী প্রযোজকরাই 'পলাতক' প্রযোজনা করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু অনুপ কুমারের বদলে অন্য কাউকে নায়ক করার আপোষে হাঁটেননি। শেষ অবধি বোম্বের এক বিখ্যাত প্রযোজক অনুপ কুমার কে নায়ক করেই 'পলাতক' প্রযোজনা করতে রাজি হন। 'পলাতক' মুক্তির পরের অধ্যায় আজ ইতিহাস। মায়ের কাছে শুনেছি পলাতকে'র সব শো-টাইমই হাউসফুল যেতো এবং সিনেমা শেষে প্রত্যেক বয়সের দর্শকই ভাষাহীন হয়ে যেতো। এখানেই একজন শিল্পীর সার্থকতা।
একইভাবে আপোষ করেননি মূল্যবোধ ও নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে। ২০০৬-০৭ পরবর্তী পালাবদল, দলবদলের যাত্রাপালায় আনুগত্য বিক্রির প্রতিযোগিতায় বিন্দুমাত্র সামিল হওয়ার চেষ্টা করেননি। নন্দন, রবীন্দ্রসদন, শিশিরমঞ্চ ইত্যাদি জায়গায় প্রবাদপ্রতিম সিনেমাব্যক্তিত্বদের নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা সেরে যাঁরা পরেরদিন সকালে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যশিবিরে নাম লেখানোর লাইনের ভিড়ে অপেক্ষমাণ, তরুণবাবু সেই ভিড় থেকে সযত্নে দূরত্ব বজায় রেখে নিজের রাজনৈতিক দর্শনে অবিচল থেকেছেন। শুনেছি "পরিবর্তন-উত্তর" যুগে কোনো একদিন কোনো একটি সেমিনারে এক সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে হাসির ছলে সেই মঞ্চেই বসা এক কবি'র উদ্দেশ্যে তরুণবাবু বলেছিলেন তিনি খুব একটা আধুনিক নন ব'লে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না, আর তাই উনি "ওঁদের" মতো বদলাতে পারেন না! আক্ষরিক অর্থেই তরুণবাবু ছিলেন সমসাময়িক রাজনীতির বিবেক। তাই মৃত্যুর আগে তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল নন্দন বা রবীন্দ্রসদন জাতীয় জায়গায় যেনো তাঁর মরদেহ না রাখা হয়, মরদেহে কোনোরকম ফুল, মালা যেনো না দেওয়া হয়, মরদেহ নিয়ে কোনোরকম মিছিলের ভিড় থেকে তিনি দূরেই থাকতে চান এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সম্মানের বন্দুকের আওয়াজে যেনো তাঁকে বিরক্ত না করা হয়। মৃতের প্রত্যাখ্যানের এই অহংকার ওঁকেই মানায়। "আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়" বোধহয় একেই বলে। খুবই সামান্য দুটি শেষ ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন - ওঁর মরদেহের ওপর যেনো একটি গীতাঞ্জলি ও একটি কাস্তে-হাতুড়ি দেওয়া লাল পতাকা রাখা হয়। পরিবারের লোকেরা দুটো ইচ্ছেই পূরণ করেছেন। উনি চোখ এবং দেহ - দুটোই দান করে গেছেন। ভীষন আশা রাখি যে, যে ব্যক্তি ওঁর চোখদুটি দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখবেন, তিনি যেনো গাইতে পারেন -
"চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহিরে"।

Rest in ideology তরুণবাবু ।

পুনশ্চঃ এইমাত্র দেখলাম কল্যাণ সেন বরাট বলেছেন "ওঁর মেরুদণ্ডটার সংরক্ষণ করার দরকার ছিল"।

সুমন সিনহা
০৪/০৭/২০২২



Random Thoughts - 13

Spring - The other side of the coin Nature heralds the advent of spring, a time which symbolizes freshness and renewal and more than this, i...