Wednesday, May 19, 2021

অধ্যাপক পূর্ণেন্দু সেন

 এ শোক বড়ই ব্যক্তিগত...

আজ দুপুর একটা একত্রিশ মিনিটে দেবোজ্যোতি দার সংক্ষিপ্ত একটা মেসেজ "P.S স্যার নেই"। অফিসে থাকাতে মেসেজ টা সাথে সাথে দেখতে পারিনি। দেখার পর কিছুক্ষণ বাকস্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। এত স্মৃতি, এত কথা, এত ভালোবাসার ভার যে কি দুঃসহ হতে পারে তা আজ বুঝছি। এ আমার পিতৃবিয়োগের সমান। হ্যাঁ, P.S নামেই গোটা বহরমপুর আর মুর্শিদাবাদের মানুষ তাঁকে এক ডাকে চিনতেন। বহরমপুর কৃষনাথ কলেজের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক পূর্ণেন্দু সেন আজ সকালে প্রয়াত হয়েছেন। মূলতঃ যাঁর জন্য পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা নিয়ে ফিজিক্স অনার্স পড়া ও পরবর্তী কালে যাঁর অসম্ভব প্রভাব আমার জীবনে, তিনি চলে গেলেন আর দু হাজার কিমি দূরে বসে তাঁর শেষকৃত্যে না থাকতে পারার যন্ত্রণা ও অসহায়তা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
স্যারের কাছে প্রথম ফিজিক্স পড়তে শুরু করি উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই পড়া শুরু হয়ে গেছিল। স্যারের কাছে পড়ার চান্স পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে সবার মধ্যেই একটা দুশ্চিন্তা থাকতো কারণ বহরমপুর শহরে ওঁনার কাছে পড়ার একটা বিশাল ডিমান্ড বা ক্রেজ ছিল সে সময়। আমাকে সেসব ভাবতে হয়নি কারণ আমার দিদিও ওঁনার কাছে পড়তেন। তাই মাধ্যমিকের পর প্রথম যে দিন ওঁনার বাড়ি যাই দিদির সাথে, ওনার সেই অননুকরনীয় হাসির সাথে উনি দিদি কে বলেছিলেন "তোর ভাই, পাঠিয়ে দিস"। সেই শুরু... পরের টা আজ ইতিহাস।
ওঁনার পড়ানোর একটা অদ্ভূত অনন্য স্টাইল ছিল। থিওরির থেকে প্রবলেম সলভ করার ওপর গুরুত্ব বেশি দিতেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়বার সময়ই সব ছাত্র ছাত্রীদের পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে অঙ্ক কষতে যদি উৎসাহ না থাকে, তাহলে ফিজিক্স না পড়াই না ভালো! উনি পদার্থবিদ্যার থিওরি গুলোও বোঝাতেন অঙ্ক নির্ভর করে। উচ্চমাধ্যমিকের দু বছরে এমন একটা দিনও মনে পড়ছে না যেদিন উনি কোনো অঙ্ক করান নি! ক্লাস XI- এ নিউটনিয়ান মেকানিক্স পড়ানো শুরু করবার আগে উনি ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস শিখিয়েছিলেন কারণ আমাদের সময়ে ক্যালকুলাস ছিল ক্লাস XII এর অঙ্ক সিলেবাসে। আর যেহেতু ক্যালকুলাস ছাড়া নিউটনিয়ান মেকানিক্স অসম্পূর্ণ, তাই আগে ক্যালকুলাস শেখো, তারপর নিউটনিয়ান মেকানিক্স পড়ো। আমাদের পড়াতেন আর একটার পর একটা সিগারেট পোড়াতেন। দুটোই বোধহয় সমান নেশা ছিল! উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ফিজিক্স অনার্স নিয়ে কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হলাম। তারপর থেকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে স্যারের সাথে। কি অকৃত্রিম যে ভালোবাসতেন আর স্নেহ করতেন আমাকে। কলেজে এমন কোনো ছাত্র ছাত্রী ছিল না যে স্যারের একটা ক্লাসও মিস করত। সিম্পলিসিটি একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিল স্যার কে, সে পড়ানোর ক্ষেত্রেই হোক বা ব্যক্তি জীবনেই হোক। কিন্তু খুব কড়া ছিলেন। সবাই সমীহ করতেন। কলেজের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে। অনেক বন্ধু বান্ধবই কিছু শিক্ষকের থিওরি ক্লাস করত না কিন্তু প্র্যাকটিকাল করতে আসত। স্যার এটা লক্ষ করেন এবং একদিন হঠাৎ থিওরির অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টার হাতে নিয়ে প্র্যাকটিকাল শুরু হওয়ার আগে ল্যাবের সামনে বসে আছেন। যারা সব থিওরি ক্লাস করে নি, তারা ল্যাব করতে পারবে না। সেদিন মাত্র দুজন ল্যাব করতে পেরেছিল, আমি আর অভিজিৎ। অনেক অনুরোধ, কাকুতি মিনতি করেও স্যার আর কাউকে ল্যাবে ঢুকতে দেন নি। এবং উনি বলেছিলেন এরকম হঠাৎ হঠাৎ উনি এবার থেকে চেক করবেন এবং থিওরি না করলে ল্যাব করা বন্ধ করে দেবেন। না, কেউ কোনো আন্দোলন বা অভিযোগ করে নি সেদিন। উল্টে পরের দিন থেকে কেউই অকারণে আর থিওরি ক্লাস মিস করার সাহস দেখায় নি। পরের দিন থিওরি ক্লাসে উনি সব ছাত্র ছাত্রী দের অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছিলেন যে "সব শিক্ষক শিক্ষিকা কখনোই একই রকম পড়ান না, প্রত্যেকের পড়ানোর নিজস্ব ধরণ থাকে। পছন্দ হচ্ছে না বলে কিছু শিক্ষক শিক্ষিকার ক্লাস বাঙ্ক করব, এটা অসভ্যতামী ও শিক্ষক শিক্ষিকার প্রতি অপমান করা। তোমরা মনে রাখবে প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষিকাই ক্লাসের আগে একটা প্রিপারেশন নিয়ে আসেন। বুঝতে না পারলে একাধিকবার জিজ্ঞেস করবে কিন্তু হতাশ করবে না। ভালো না লাগলেও তাঁদের ক্লাস নোটস্ গুলো নিয়ে রাখবে, পরীক্ষার আগে সুবিধে হবে। কিন্তু ক্লাস বাঙ্ক কখনো করবে না।" এই ছিলেন স্যার। কখন যে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক টা ব্যক্তিগত হয়ে গেছিল, বুঝতেই পারিনি। কত সময় যে স্যারের বাড়িতে কেটেছে। তখন বোধহয় B.Sc সেকেন্ড ইয়ার। কিছু একটা বুঝতে না পেরে স্যারের বাড়ি গিয়েছি আলোচনা করতে। স্যার বলেছিলেন "দেখ সুমন, প্রত্যেক টা সাবজেক্টের একটা নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। ইকনমিক্স বা ইতিহাসের যেমন একটা ভাষা আছে, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বা অঙ্কেরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। সেটা যদি বোঝার চেষ্টা না করিস, তাহলে সেই সাবজেক্টের ভেতরে ঢুকতে পারবি না কোনোদিন।" সেদিন কত টা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম জানি না, তবে বয়স বা অভিজ্ঞতা যতো বেড়েছে তত উপলব্ধি করেছি কথাটার অর্থ। বহরমপুর ছেড়ে সায়েন্স কলেজে M.Sc পড়তে যাওয়ার আগে যে দিন প্রণাম করতে গেলাম স্যারের বাড়ি, চলে আসার আগে বলেছিলেন "পিএইচডি টা করিস যেনো"। M.Sc পাস করার পর সাথে সাথে কোনো রিসার্চ ফেলোশিপ পেলাম না। সাতদিনের মধ্যেই কলকাতার বাসন্তীদেবী কলেজে আংশিক সময়ের শিক্ষকের পদে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে চান্স পেয়ে গেলাম। ওখানেই পড়াতে শুরু করলাম। বহরমপুরে স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম ও কলেজে পড়ানোর ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম। শুনে বললেন "যা পড়াবি বোর্ডে পুরো টা লিখবি। আর ডেরিভেশন করার সময় কোনো স্টেপ বাদ দিবি না। তুই যেটা পড়াচ্ছিস সেটা যে সবাই বুঝছে, তা কখনোই ধরে নিবি না। কিন্তু বোর্ডে যা লিখবি সেটা সবাই লিখে নেবে। পরে ছাত্র ছাত্রী রা তোর ক্লাস নোটস্ টাই দেখবে যে সুমন স্যার কি কি পড়িয়েছিল ক্লাসে। আর কখনোই এক টানা বোর্ডে লিখে যাবি না। ছাত্র ছাত্রী দের 'ফেস রিড' করার চেষ্টা করবি আর প্রশ্ন করবি। তাতে নিজেকে অ্যাসেস করতে পারবি কত টা ভালো বা খারাপ পড়াচ্ছিস।" পরবর্তী কালে যেখানে যা পড়িয়েছি, স্যারের কথা গুলো মনে রাখার চেষ্টা করেছি। সেদিনও আসার আগে বলেছিলেন "একটা ফেলোশিপ জোগাড় করে PhD টা করিস, বেশী দেরী করিস না"। তার পরে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে ঢুকি, খুব খুশি হয়েছিলেন। যখনই বহরমপুরে গিয়ে ওঁনার সাথে দেখা করতে গেছি তারপর, উনি বলতেন "কি গবেষণা করছিস একটু বোঝা তো দেখি", সাথে সেই অননুকরনীয় হাসি। আর কাকিমা কে বলতেন " সুমন এসেছে, লিকার চা করো"। লাস্ট যখন ২০১৯ এর নভেম্বরে বহরমপুরে গিয়ে দেখা করতে গেলাম ওঁনার সাথে, তখন কাকিমা আর নেই। স্যারের চেহারা টাও বেশ ভেঙে গেছে দেখলাম, শরীরও ভালো ছিল না খুব একটা। তবু কাজের দিদি কে বললেন "লিকার চা করো"। আশি বছর বয়সেও অশক্ত শরীরে উনি মনে রেখেছেন আমি লিকার চা খেতে ভালোবাসি। কতটা আন্তরিকতা থাকলে এই আপাত তুচ্ছ ব্যাপার গুলো লোকে মনে রাখে তাই ভাবছিলাম। কত বিষয়ে যে কত কথা হয়েছিলো সেদিন!
অধ্যাপক ছাড়াও ব্যক্তি পূর্ণেন্দু সেন কে নিয়ে দু চার কথা না বললেই নয় আজ। যে পরিশ্রম আর যত্ন নিয়ে 'কৃষ্ণনাথ কলেজ প্রাক্তনী সংসদ' (Krishnath College Alumni Association) উনি গড়ে তুলেছিলেন তা আমার মতো অনেকেই নিজের চোখে দেখেছেন। একটা সংগঠনের সাথে অনেক লোক জড়িয়ে থাকেন। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম মতামত। তবুও সবাই কে নিয়ে কিভাবে একটা সংগঠনকে চারাগাছ থেকে মহীরুহে রুপান্তরিত করতে হয়, স্যার সেটা দেখিয়ে গেছেন। আক্ষরিক অর্থেই আজ আমরা অভিভাবকহীন। প্রাক্তনী সংসদ কে পূর্ণ অবয়ব দিতে গিয়ে কখন আবেগ কে গুরুত্ব দিতে হয় আর কখন শক্ত হাতে হাল ধরতে হয়, প্রয়োজনে অপ্রিয় সত্য বলেও, তা শিখেছি আমি স্যারের কাছে। প্রাক্তনী সংসদের শুরুর দিনগুলো খুব মনে পড়ছে আজ। তখন আমি কলকাতায় পড়াশোনা করছি। কি প্রচণ্ড অধিকারবোধ থেকে আমাকে কত কিছু করতে বলতেন। কত বড় বড় ব্যক্তির সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন আমার। প্রাক্তনীর প্রত্যেক টা সভা তে বক্তৃতা দিতেন মূল বিষয় থেকে একটুও সরে না গিয়ে অথচ কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো শক্ত শব্দ প্রয়োগ নেই! সম্ভবত সেটা ২০০৩ বা ২০০৪ সাল। কলকাতার নন্দন-২ প্রেক্ষাগৃহে প্রাক্তনী সংসদের সভা। সেই প্রথম রাজা সৌমেন্দ্র নন্দী প্রাক্তনী সংসদের কোনো সভা তে আসছেন। আমাকে আর কৌনিক কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো যাঁরা প্রাক্তনী সংসদে যা দান করবেন, তার রসিদ কেটে দেওয়া। সেদিন স্যার 'প্রাক্তনী সংসদের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তব অবস্থা' নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সভা শেষে চা জলখাবারের সময় প্রায় প্রত্যেকেরই আলোচনার বিষয় ছিল স্যারের বক্তৃতা। কিন্তু কোনোদিন নিজেকে এতটুকুও জাহির করেন নি। প্রাক্তনী সংসদের কাজ, দায় ও দায়বদ্ধতা নিয়ে সবসময়ই বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কলেজের নাম পরিবর্তন নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। শেষবার যখন দেখা করতে গেলাম তখনও জিজ্ঞেস করছিলেন কি করে কি করা যায়। আক্ষেপ থেকে গেলো শেষ দেখে যেতে পারলেন না।
যে কোনও বিষয়ে নিজের মতামত দেওয়া থেকে নিজেকে কখনো দূরে সরিয়ে রাখেন নি স্যার। গা বাঁচিয়ে চলাটাই যখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন স্যার ছিলেন উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। অফিস থেকে ফিরে প্রাক্তনী সংসদের বর্তমান সেক্রেটারির সাথে কথা হচ্ছিলো। শেষের দিকে স্যার খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন। কোভিড - 19 রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পর হয়তো একটু আশার আলো জেগেছিল সবার মনে। কিন্তু না, স্যার কি কিছুটা সেচ্ছামৃত্যুও চেয়েছিলেন? যে সব কান চারপাশের লোকজনের গুণগান শুনতে অভ্যস্ত, স্যার কোনোদিনও তা রপ্ত করতে পারেন নি। চানও নি। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েও হয়তো সেটাই বুঝিয়ে গেলেন। ওঁনার ঋজু মেরুদন্ডই আমাদের আগামীর পাথেয় হোক।
Rest in Physics স্যার।
নিচের ছবিটি ২০১৯ এর নভেম্বর মাসে ওঁনার বাড়িতে তোলা। দেবোজ্যোতি দা তুলে দিয়েছিলো।

সুমন সিনহা
১৮/০৫/২০২১


2 comments:

Anirban said...

ভালো লিখেছিস। এমন মানুষ গুলো চলে যাচ্ছে রে।আমাদের একা করে দিয়ে

Unknown said...

Very nicely written...

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...