Sunday, December 5, 2021

একটি কাল্পনিক কথোপকথন

 অতীত: কেমন আছিস? চিনতে পারছিস?

বর্তমান: তুই ছিলিস বলেই তো আমি আছি। তাই চিনতে পারব না কেন?

অতীত: কেমন আছিস বললি না তো?

বর্তমান: এই বেশ ভাল আছি... চেনা আলো আর চেনা অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে।

অতীত: বাহ, তা চেনা মাটি, চেনা পাড়ায় আজকাল আর দেখতে পাইনা যে?

বর্তমান: চেনা চেনা হাসিমুখ গুলোকে আর তেমন ভাবে খুঁজে পাইনা রে... তবু মাঝে মধ্যে চেনা পথে কড়া নেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি এখনো।

অতীত: মিছিলে হাঁটিস? সেই যে তোরা একসাথে একসুরে গাইতিস – পায়ে পায়ে হেঁটে যাবো, মানুষেতে মিশে যাবো, তখনই মুক্ত হবে আমার এ গান...

বর্তমান: না রে। অনেকদিন মিছিলে হাঁটা হয়নি। অনির্বাণরা অনেকেই আজ বেসুরো। তাই একসুরে গাওয়া হয়না আর। তবে শুনি, একা একা গাই কখনো সখনো।

অতীত: হতাশা?

বর্তমান: কখনোই নয়। আমি সবসময়ই আশাবাদী। কিন্তু বাস্তব কে অস্বীকার করতে চাই না।

অতীত: তাহলে স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা?

বর্তমান: বয়স হওয়ার মানেই তো স্মৃতির সাথে আড্ডা দেওয়া! সেদিন তো তুই বর্তমান ছিলিস আর আমি ভবিষ্যৎ। তাই সেদিনের অবস্থার প্রেক্ষিতে আজকের অবস্থাকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা ঠিক নয়। ইতিহাস তো একটা বহমান প্রক্রিয়া।

অতীত: কিন্তু যারা বেসুরো তারাই তো লাভবান – বিভিন্নভাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা তারাই তো মেজরিটি।

বর্তমান: লাভ ক্ষতির অঙ্ক দিয়ে তো জীবনের অর্থ মাপা যায় না। আগেও হিসেবী ছিলাম না, এখনও বেহিসেবী। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (Majoritarianism), সে যে ফর্মেই হোক না কেন, হেরে যাওয়ার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্তের সাক্ষী তো তুই নিজেই।

অতীত: কিন্তু হিসেব মেলানোর কোনো দায় নেই? সেটা তো একধরনের দায় এড়িয়ে যাওয়া। চারিদিকে যে এখন এত উন্নয়ন, সেটা তো বাস্তব।

বর্তমান: উন্নয়নের সংজ্ঞাও তো ‘মেজরিটি’ নির্ধারণ করছে। উত্তরসত্য (Post truth) যুগে উন্নয়নের রঙীন ফানুসে ভাসতে ভাসতে নাগরিক পিছু ঋণের পরিমাণের হিসেবটা ডুবেই থেকে যায়। নামের রকমফেরে বিভিন্ন শ্রী-সাথী প্রকল্প, জাতীয় সম্পদ (National asset) বিক্রী, ব্যাংক/বীমা/টেলিকম বেসরকারিকরণ (Privatization) ইত্যাদি উন্নয়নের অর্থনৈতিক মডেল। আর তার সমান্তরাল ক্ষতি (Collateral damage) হল লাগামছাড়া দুর্নীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি...

অতীত: মানুষ তো এতেই খুশি।

বর্তমান: মানুষ না ‘মেজরিটি’? তবে এটা ঠিক যে মেজরিটি আর বিপ্লব চায় না, পরিবর্তন চায়।

অতীত: তা বিপ্লবপন্থীদের তো আর রাস্তাঘাটে দেখতে পাওয়া যায় না। প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলোও তো আর শুনতে পাওয়া যায় না ।

বর্তমান: পায়ের তলায় মাটি না থাকলে বিপ্লব হয় না। আর প্রতিবাদ কি শুধুই শব্দময়? এটা উত্তর আধুনিক যুগ (Post modernization) অর্থাৎ বাজার নিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ (Consumerism) আর আমরা হলাম ভোগকারী বা উপভোক্তা (Consumer) অর্থাৎ ভোটার অর্থাৎ কিনা পণ্য (Commodity)। তাই যা দেখাতে/শোনাতে বাধ্য করা হয়, যা দেখতে/শুনতে বাধ্য করা হয়, তাই দেখতে/শুনতে হয়।

অতীত: তা নিঃশব্দ প্রতিবাদ টা ঠিক কিরকম? দেখা যায় বা বোঝা যায়?

বর্তমান: চোখ কান খোলা রাখলে বা বুদ্ধি বন্ধক না রাখলে কিছুটা তো বোঝা যায় বটে। এই তো কিছুদিন আগে লোকজন ফিসফাস করছিল যে বৃষ্টির জমা জলে নাকি আমাদের প্রিয় শহরের উন্নয়নের নীল সাদা রঙগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারপর সেদিন দেখলাম যে মুদিখানা দোকানে এক খরিদ্দার সর্ষের তেল কেনবার সময় দোকানদার কে বলছেন যে সর্ষের তেলের ঝাঁজে নাকি আর চোখ জ্বালা করে না, সর্ষের তেলের দামে চোখ জ্বালা করে । আশেপাশের লোকজনকে সহমত পোষণ করতে দেখলাম। আরো শুনছি যে এক দেড় বছর আগে যারা সন্ধ্যাবেলায় উন্নয়নের কাঁসরঘণ্টা বাজিয়েছিলেন বা ঘরদোর অন্ধকার করে সেজেগুজে মোমবাতি, প্রদীপ হাতে ফটো তুলে ভূতবুক, কোস্টাগ্রাম, ভাটেরঅ্যাপ ইত্যাদিতে পোস্টিয়ে দেশপ্রেমের প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন, তাদেরও নাকি পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাস কিনতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। সেসব নিয়ে নাকি তারা নিজেরা কিসব বলাবলি করছেন।

অতীত: ভূতবুক, কোস্টাগ্রাম... এসব আবার কি?

বর্তমান: ওহ, তুই তো আবার সেকেলে। ওগুলো উত্তর আধুনিক – উত্তরসত্য যুগের বাইপ্রোডাক্ট। লোকজন এসব কে ভার্চুয়াল মাধ্যম (Space) বলে।

অতীত: আচ্ছা, সেদিন একজন বলছিল কি একটা এম.আই.টি সেল হয়েছে যেখানে নাকি বিভিন্নরকম মাস্টারস্ট্রোক বিশ্লেষণ করা হয়। সেটা কি রে?

বর্তমান: ওটার বাজার এখন একটু ডাউন যাচ্ছে।

অতীত: কেন?

বর্তমান: ওই বছর খানেক আগে কি একটা আইন পাশ হয়েছিল। এম.আই.টি সেল থেকে শুরু করে ভোগবাদের ফসল (Product of consumerism)খবর পরিবেশকরা, যাদের তুই সাংবাদিক বলতিস, সবাই একসুরে সেটাকে মাস্টারস্ট্রোক বলেছিল। অনেক “পড়াশোনা না-জানা” চাষাভুষা লোকজন সেই আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছিল। গেলবার সাধরণতন্ত্র দিবসে তারা অনেক ট্রাক্টর নিয়ে রাজপথে ঢুকে হুলস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছিল নাকি।ছুটির দিনে ড্রইংরুমে বসে টিভিতে সেসব দেখে ভক্তিবাদী বাবুবিবিদের কি গোঁসা! আর সেই আগুনে ঘি ঢালছে ‘মেজরিটি’ খবর পরিবেশক। বিবিধ বিশেষণে চাষাভুষা লোকগুলো কে ভূষিত করছে। সে অনেক কিছু হওয়ার পর হঠাৎ করে সেই আইন প্রত্যাহার হয়ে গেছে। ফলে এম.আই.টি সেল থেকে শুরু করে খবর পরিবেশকদের মালিক-মালকিনদের কাছে এখনো বোধহয় নির্দেশ আসেনি এটাকে মাস্টারস্ট্রোক দিয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। তাই ওটা এখন একটু ডাউন যাচ্ছে।

অতীত: চাষাভুষা লোকগুলোর মত যদি বাকি ভোটাররাও জোট বাঁধে?

বর্তমান: বিশাল সংখ্যক এই ভোটারদের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস প্রবলভাবে প্রকট এবং বহুমাত্রিক যেমন ধর্মীয় বিন্যাস, জাতিগত বিন্যাস, ভাষাগত বিন্যাস ইত্যাদি। আর এসবের ওপরে আছে অর্থনৈতিক বিন্যাস। এছাড়াও একটা বড় অংশের ভোটারদের স্বার্থ, লোভ, দ্বিচারিতা, চিন্তার দৈন্যতা এসবতো আছেই। তাই চাষাভুষা ভোটারদের মতো বাকি ভোটারদের জোট বাঁধার সমীকরণ অতটা সহজ সরলরৈখিক নয়। এছাড়া অনিয়য়ন্ত্রিত অর্থ ও পেশী শক্তির দাপটের কাছে একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার অসহায়।

অতীত: কিন্তু এই অর্থের যোগান ও পেশীশক্তি যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারাও তো ভোটার!

বর্তমান: তারা শুধু ভোটার নয়, রাজা, রানী, নেতা, মন্ত্রী, শাসকও এদের মধ্যে থেকেই হয়। আর সবার মত এরাও জানে যে এই শ্রেণীবিন্যাস একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এই শ্রেণীবিন্যাস কে এরা কদর্য শ্রেণীবিভেদের   রূপ দেয়। অর্থনৈতিক বিভেদ জিইয়ে রাখবার ও প্রসারিত করবার জন্য দরকার কিছু অর্থনৈতিক নীতি (Policy) ও তার রূপায়নের জন্য চাই কিছু মডেল। আর বাকি বিভেদ গুলো প্রকটতর করবার জন্য চাই (অপ)প্রচার ও প্রোপাগান্ডা যার জন্য আছে ওই এম.আই.টি সেল, ভার্চুয়াল ও মেজরিটি মুলস্রোত মাধ্যম ইত্যাদি। এদের চাই টাকা, তারজন্য আছে কিছু ব্যবসাদার যাদের কাছে আবার আছে অঢেল পুঁজি (Capital)। এই সবকিছুকে চালনা (Sponsor) করে ওই মুষ্টিমেয় ব্যবসাদারই কারণ মুনাফা (Profit) ভোগ করে এরাই। এই মুনাফার একটা অংশ চলে যায় সেই সব ভোটারদের কাছে যারা ভাগ্যক্রমে রাজা, রানী, নেতা, মন্ত্রী ইত্যাদি হয়। এই চেনসিস্টেম টা একটা vicious cycle

অতীত: কিন্তু ব্যবসাদাররা তাদের মুনাফার অংশ অন্যদের দেবে কেন?

বর্তমান: কারণ একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ঐসব পলিসিগুলোকে বিল রূপে পাশ করানোর জন্য একটা আইনসভার প্রয়োজন পড়ে আর এই আইনসভা অলংকৃত করে থাকেন রাজা, রানী, নেতা, মন্ত্রীরা। গণতন্ত্রের ফাঁকফোকড় গ’লে আইনগুলোও পাশ হয়ে যায়।

অতীত: সেকি!তার মানে গণতন্ত্র জিনিস টা খারাপ বলছিস?

বর্তমান: খারাপ তো বলিনি! তোর কাছেই তো একদিন শুনেছিলাম গণতন্ত্রের থেকে একনায়কতন্ত্র অনেক ভালো যদি নায়ক সেখানে ভালো হয়। যাই হোক, গণতন্ত্র (Democracy) যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (Majoritarianism) হয়ে যায় তাহলে সেটা ভয়ঙ্কর কারণ দ্বিতীয়টি স্বৈরতন্ত্রের (Fascism) পালিশ দেওয়া চেহারা। যেটা দরকার সেটা হল সামাজিক গণতন্ত্র (Social democracy)।

অতীত: কিন্তু এই সামাজিক গণতন্ত্র কি বাস্তবিকভাবে সম্ভব?তুই তো বললি যে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণীবিন্যাস বা শ্রেণীবিভেদ একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সত্য।

বর্তমান: ঠিক কিন্তু এই যে কোন ধরনের বিভেদের মূল ও প্রাথমিক কারণ হল শিক্ষার অধিকার থেকে সব মানুষ বা ভোটারদের বঞ্চিত করে রাখা কারণ শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে ... শিক্ষার সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য চাই কিছু নীতি (Policy) আর আগেই বললাম যে নীতি রূপায়নের জন্য চাই আইনসভা ।অতএব, ‘মেজরিটি’ যদি আইনসভায় না থাকে তাহলে ওই vicious cycle টা আবর্তন করতে পারবে না মানে অঙ্কের হিসেব উল্টে যাবে।

অতীত: কিন্তু আমাদের সময় থেকে তো তোদের সময়ে শিক্ষার হার বেশি ?

বর্তমান: এইখানেই প্রোপাগান্ডার গুরুত্ব। সেই যে গোয়েবেলস সাহেব কি একটা বলেছিল না! স্বাক্ষরতা ও শিক্ষাকে   সমার্থক করে দিয়ে এমন প্রচার ও প্রোপাগান্ডা করা হয়েছে যে আমাদের ভোটারদের সব ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। সে যাই হোক, তোর সময়ের মত সস্তায় শিক্ষা এখন আর পাওয়া যায়না, অনেক টাকা লাগে।

অতীত: তাহলে যাদের টাকা পয়সা নেই তারা পড়াশোনা করবে কি করে? আবার বলছিস যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও বেড়ে যাচ্ছে!

বর্তমান: সবার শিক্ষার অধিকার আর রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার (Priority) নয়। একই ছবি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও। তাই শিক্ষা স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম।

অতীত: তাহলে তারা চাকরিবাকরি, ব্যবসাপত্তর, কাজকর্ম – এসব কি করে করবে? তার জন্য তো শিক্ষা দরকার।

বর্তমান: তোর সময়ের ‘আমাদের ভিত্তি আর ভবিষ্যৎ’ নিয়ে যে একটা শ্লোগান ছিল, সেদিন মেজরিটি ভোটারদের একজন আমায় বললো সেটা নাকি এখন  “ভাতা আমাদের ভিত্তি, ভিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ” হয়ে গেছে। মানে কোথাও একটা আশাভঙ্গ শুরু হয়েছে। আর এই মেজরিটি ভোটাররাও যেদিন বুঝতে শুরু করবে যে তারা বা তাদের নিজের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ অনথিভুক্ত বেকারদের মধ্যে একজন অথবা চুক্তিভিত্তিক কর্মী, সেদিন তারা নিশ্চয়ই অন্যরকম ভাববে।

অতীত: এটা কি তোর বিশ্বাস?

বর্তমান: নিশ্চয়ই। আর মানুষ কে অবিশ্বাস করার থেকে বিশ্বাস করে ঠকা ভালো।

অতীত: সেই নির্মাণ-বিনির্মাণ (Construction-deconstruction) তত্ত্ব?

বর্তমান: সবকিছুই সময় অর্থাৎ ভবিষ্যৎ বলবে। আর ভবিষ্যতের কাছে তুই আর আমি তো আলাদা নই, দুজনেই অতীত! এখন তোর কাছ থেকেই একসময় শোনা কিশোর কবির কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে -

“মনে রেখো দেরী হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরী
আর মনে করো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ
অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন”।

ঋণস্বীকার: কবীর সুমন এবং নচিকেতার দুএকটি গানের লাইন এই কথোপকথনে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুমন সিনহা
০৫/১২/২০২১


এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...