Wednesday, June 23, 2021

নবারুণ ভট্টাচার্য

"সময় হয়েছে বৃদ্ধ, ফিরে গেছে বিপ্লবের শীতও
হৃদয়ই যখন রাষ্ট্র, ভালবাসা সন্ত্রাসজনিত।
পুড়ে গেছে দেশ, তবু চেতনায় ধরেনি আগুন...
কে আর বিশ্বাস করবে, আমাদেরও ছিল নবারুণ?"

সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন যে বাঙালিদের একজন নবারুণ ছিলেন! প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ও নবারুণ ভট্টাচার্য সমার্থক হয়ে গেছিল। ১৯৪৮ সালের আজকের দিনেই মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে ঔপনাসিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, কবি ও চিরবিদ্রোহী নবারুণ ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। সাহিত্য ও শিল্পচর্চা উত্তরাধিকার সূত্রেই মজ্জাগত। দাদু ছিলেন কল্লোল যুগের নামকরা লেখক মণীষ ঘটক ও ছোটদাদু ছিলেন প্রতিভাবান চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।

প্রথমে ভূতত্ববিদ্যা (আশুতোষ কলেজ) ও পরে ইংরেজি সাহিত্য (সিটি কলেজ) নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। কলেজের পড়া শেষ করে উনি "সোভিয়েত দেশ" পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু করেন এবং দীর্ঘদিন ওই পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে কর্মজীবন বলতে তাঁর আজীবন সাহিত্য সাধনার কথাই মূলতঃ বোঝায়। ১৯৬৮ সালে প্রথম ছোটগল্প 'ভাসান' লিখেই তাঁর লেখক সত্ত্বার আত্মপ্রকাশ। গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন নিয়মিত। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়"। বাহাত্তরের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ দিয়ে শুরু হয় তাঁর কবিতার পথ চলা। প্রান্তিক মানুষদের অসহায়, যন্ত্রণাক্লিষ্ট যাপনচিত্র, তাদের টিকে থাকার লড়াই ও বেঁচে থাকার কৌশল বারেবারে ঘুরে ফিরে এসেছে ওঁনার কবিতায়। বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ন নতুন একটি স্বকীয় ধারার সৃষ্টি করেন উনি। মানুষের দুঃখ দুর্দশা, পরাজয় এবং পরিণামে মৃত্যু ও আত্মহননের আলেখ্য তাঁর গল্প, উপন্যাস ও কবিতা জুড়ে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'হারবার্ট'। সত্তরের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাস আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলো। এই উপন্যাসের জন্যই ১৯৯৪ সালে নরসিংহ দাস পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে বঙ্কিম পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন নবারুণ ভট্টাচার্য।পরবর্তীকালে এই উপন্যাসকেই একই নামে চলচ্চিত্রায়িত করেন পরিচালক ও নাট্যকার সুমন মুখোপাধ্যায়। ৫৩ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে 'হারবার্ট' শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে নির্বাচিত হয়। ওঁনার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গুলি হল 'কাঙাল মালসাট', 'লুব্ধক', 'মসোলিয়ম', 'খেলনানগর', 'হালাল ঝান্ডা', 'রাতের সার্কাস' ইত্যাদি। প্রতিটি উপন্যাসের মধ্যেই ওঁনার প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভাবমূর্তি ধরা পড়ে। তাঁর লেখা 'কাঙাল মালসাট' উপন্যাসটিকে সুমন মুখোপাধ্যায় মহাশয় নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ও পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

তিনি ফ্যাতাড়ু নামে একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র তৈরী করেন এবং ততোধিক জনপ্রিয় শব্দবন্ধ 'ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই' তাঁরই লেখনীর ফসল। এই ফ্যাতাড়ুরা আসলে হতভাগ্য শ্রেণীর প্রতিনিধি। সাহিত্যের চিরাচরিত নিয়ম ভাঙায় সিদ্ধহস্ত নবারুণ বাবুর ফ্যাতাড়ুরা ছিল ভাষা ব্যবহারে সাহসী ও আচরণে নির্ভীক। এই ফ্যাতাড়ুরা এতই জনপ্রিয় ছিল যে একটা সময় দেখেছি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ তরুণীদের টি-শার্টের সামনে পিছনে 'ফ্যাতাড়ু' এবং 'ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই' লেখা থাকতো!

নবারুণ বাবু কোনোদিনই নামী সংবাদপত্র বা জার্নালের জন্য লেখেন নি। লেখালেখির পাশাপাশি উনি মঞ্চে অভিনয়ও করেছিলেন এবং অভিনয়ই ওঁনাকে ধীরে ধীরে পরিচিতি দেয়। আজীবন বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী থাকলেও কখনোই কোনো সরকারের তাঁবেদারি করেন নি বা কোনো সরকারের কাছাকাছি ঘেঁসেন নি। নিজেকে একজন প্রান্তিক মানুষ বলে পরিচয় দিতেন ও জীবনযাপন ছিল প্রকৃত অর্থে অনাড়ম্বর। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের আরামপ্রিয় জীবনের অভিলাষ ও তাদের অনুভূতিহীনতা নিয়ে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করার জন্য হয়তো শিল্প সাহিত্যের প্রশাসক মহলে উনি কিছুটা হলেও ব্রাত্য ছিলেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে অনেকে ওঁনাকে নিয়ে অস্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন
২০১৪ সালের ৩১শে জুলাই অগ্নাশ্যয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে উনি প্রয়াত হন। কলকাতার কেওড়াতলা মহাশশ্মানে যখন ওঁনার শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে, তখন সেই শহরেই মঞ্চস্থ হচ্ছে ওঁনারই অনুবাদ করা নাটক 'যারা আগুন লাগায়'! নাটকীয় সমাপতন!
জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাই নবারুণ ভট্টাচার্য।

সুমন সিনহা 
২৩/০৬/২০২১


No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...