Saturday, September 7, 2024

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন্য সুনীল" বা ওই জাতীয় কিছু লিখবো। কিন্তু ভাবনাগুলো এলেও কিছুতেই গুছিয়ে লিখে উঠতে পারলাম না। মূলত কনসেনট্রেট করতে পারলাম না। মন চঞ্চল হয়ে পড়ছে নানা বিক্ষিপ্ত চিন্তায় সবসময়। সুনীল বাবুর দু একটি কবিতা পড়লাম, দু একটি কবিতা বা কবিতার লাইন মনে করলাম। "পূর্ব পশ্চিম"-এর কিছু পাতা এদিক ওদিক করলাম। অতীন, অলি, শর্মিলাদের কথা আরো বেশি মনে পড়লো।

আজ আবার গণেশ চতুর্থী। বাতাসে একটা উৎসবের আমেজ আছে। ক্রোধ ও দ্রোহের আবহে এই প্রবাসে বাঙালিরাও "গণপতি বাপ্পা মোরিয়া" বলছে। অন্যের সংস্কৃতি, রীতিনীতিকে আপন করে নেওয়া আর কি! অবশ্য শুধু প্রবাসে কেনো, পশ্চিম বাংলাতেও এখন গণেশ চতুর্থী ধুমধাম করে হয় যা দশ বছর আগেও হতো না। আগেকার দেখা পয়লা বৈশাখের দিন বাঙালির হালখাতার সিদ্ধিদাতা গণেশ এখন বাপ্পা হয়ে গেছে। এটার মধ্যে অবশ্য কেউ রাজনৈতিক বা জাতিগত কালচারের কোনো প্রভাব আছে বলে ভাববেন না দয়া করে। এমনিতেই শিক্ষিত, সমাজ সচেতন,  আদর্শবাদী, সংস্কৃতিমনষ্ক বাঙালীরা প্রতিনিয়ত বলে থাকেন "এই রাজনীতি রাজনীতি করেই বাঙালিদের সব কিছু শেষ হয়ে গেলো"। আশা করবো তারা নিশ্চয়ই সুনীল বাবুর "ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ" পড়েছেন।

কোলকাতা সবদিক দিক থেকেই এগিয়ে থাকে, কি প্রতিবাদে কি হুজুগে। জীবনানন্দের সাধের "কল্লোলিনী তিলোত্তমা" এখন অন্য এক তিলোত্তমার বিচার চেয়ে প্রায় প্রতিদিন রাত জাগছে। তার মধ্যেই গণেশ চতুর্থী পালন হচ্ছে। এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সুনীল বাবুর "প্রথম আলো'র" কয়েকটা লাইন মনে পড়লো। লাইনগুলো এরকম ছিলো "তীর যেমন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কিছুটা পিছিয়ে আসে, ঠিক তেমনই বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে পিছু ফিরে তাকাবার দরকার আছে।"

সুমন সিনহা
০৭/০৯/২০২৪

আহা, বেশ বেশ বেশ...!!!

আজ শিয়ালদহ আদালতে আর. জি. করের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃত সঞ্জয় রায়ের মামলার শুনানিতে সি. বি. আইয়ের তদন্তকারী অফিসার (I. O) উপস্থিত ছিলেন না!! এমনকি সি. বি. আইয়ের তরফে কোনো আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন না! আদালত বন্ধ হওয়ার মুখে একজন নতুন আইনজীবী আসেন যিনি সি. বি. আইয়ের নিজস্ব আইনজীবি নন! I. O একজন সহকারী পাঠান যিনি কেসটি সম্পর্কে নাকি সম্যক অবহিত নন! শোনা যাচ্ছে বিচারপতি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন তাহলে ধৃতকে জামিন দিয়ে দেবেন কিনা! শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ বিচারপতি ধৃতকে চৌদ্দ দিনের জেল হেফাজতে পাঠান।

কোন্ রাজনৈতিক দলের ছাত্রসমাজ, নেতা নেত্রীরা চিৎকার করে যেনো বলছে ঘটনাটি নিয়ে রাজনীতি করবেন না, রাজনীতি করবেন না...
ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।

সুমন সিনহা
০৬ / ০৯ / ২০২৪

Monday, August 19, 2024

উৎপল দত্ত

আজকে এমন একজন বাঙালির মৃত্যুদিন যিনি নিজেকে কোনোদিন "বুদ্ধিজীবি" বা "শিল্পী" বলে দাবি করেন নি বা সেসব বিশেষনে পরিচিত হতে চান নি। নিজেকে কখনো "অরাজনৈতিক" বলেন নি। রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে একা লড়াই করে গেছেন। ক্ষমতার বৃত্তের কাছাকাছি ঘেঁষেন নি কোনোদিন। পুরস্কারের লোভ বা দাক্ষিন্যের নেশা কখনো তাঁকে আকৃষ্ট করে নি বরং প্রত্যাখানের সাহস তাঁকে এবং বাঙালিকে গৌরাবান্বিত করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রত্যাখ্যান করে তাঁর কৌতুকমিশ্রিত জবাব ছিলো "শাহেনশাহ্, তোমার পুরস্কার তোমার নিজের কাছেই রাখো"। তিনি উৎপল রঞ্জন দত্ত ওরফে উৎপল দত্ত।


কোনোরকম হিপোক্রিসী না করে ওঁর অকপট স্বীকারোক্তি ছিলো "সিনেমা করি পেটের দায়ে, নাটক করি নিজের দায়ে"। বিত্ত, বৈভব, ক্ষমতা ও সুবিধাবাদের গন্ধ শুঁকে বেড়িয়ে নিজেদের "এলিটিস্ট", "কালচার্ড" ভাবা লোকজনের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে ওঁর বিখ্যাত উক্তি "আমি শিল্পী নই, আমি প্রোপাগান্ডিষ্ট" আজ প্রায় প্রবাদে পরিনত হয়েছে। দু'বার "রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে" গ্রেপ্তার!! - - ১৯৬৩ তে কোলকাতায় এবং ১৯৬৭ তে মুম্বাইতে। ১৯৬৩ তে গভীর রাতে শ্রী সত্যজিৎ রায় ওঁর হয়ে থানা থেকে জামিন নিতে যান।

অগাধ পান্ডিত্য, জ্ঞান, পড়াশোনা ও বাগ্মিতা নিয়েও সারাজীবন নিজেকে গণনাট্য আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবেই নিজেকে পরিচয় দিয়ে গেছেন। প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যম ছিলো পথনাটিকা থেকে জনসভা - ক্ষমতাসীনের ছত্রছায়ায় নিজেকে নিরাপদ রেখে, গা বাঁচিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে কখনো সামিল হন নি। রাস্তায় নেমে দাপটের সাথে প্রতিবাদ করেছেন, পক্ষ নিয়েছেন। লাইমলাইটে আসার জন্য বা নিজেকে "ইমপর্টান্ট" দেখানোর জন্য কখনো হ্যাংলামি করতে হয় নি। ইতিহাস ওকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।

সত্তরের নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা "তীর" নাটকের উপাদান সংগ্রহের জন্য উনি উত্তরবঙ্গে যান। সেখানেই এক জনসভা থেকে ওঁর নির্ভীক ঐতিহাসিক স্লোগান "একদিকে নকশালবাড়ি, আর অন্য দিকে বেশ্যাবাড়ি। বুদ্ধিজীবিরা পথ বেছে নিক, কোন্ দিকে যাবেন।"

আজকে সারা দেশ জুড়ে এই ক্রান্তিকালে যখন একদিকে রাজনীতি আর অন্যদিকে অরাজনীতি - তখন পথ বেছে নেওয়ার, পক্ষ বেছে নেওয়ার সময় এসেছে যাতে আমরা অন্তত নিজেরা ভবিষ্যতে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারি। "অরাজনৈতিক" সবচেয়ে বড় সুবিধেবাদী রাজনৈতিক অবস্থান এবং তার থেকেও ভয়ঙ্কর হলো "অরাজনৈতিকতার" মুখোশের আড়ালে কোনো নির্দিষ্ট রাজনীতিকে বিভিন্ন সুকৌশলে প্রমোট করা।

সুমন সিনহা
১৯/০৮/২০২৪


Tuesday, July 23, 2024

এলোমেলো ভাবনা - ১১

প্রথমে শুরু হয় ক্ষয়। অনেকটা ক্ষয়ে যাওয়ার পর যখন আমরা টের পাই, তখন পড়ে থাকে ক্ষীণ আশা। ওই ক্ষয়ে যাওয়া আশা যেমন কখনো পুরোটা ফুরোয় না... ক্ষয় তৈরী করে ক্ষত। সময় বয়ে যায়, ক্ষত আরো গভীর হতে থাকে। কেউ কেউ সেই ক্ষততে মেকি প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করে, তাতে জ্বালা আরো বাড়ে। জ্বালা যখন অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন ক্ষতির মাত্রাটা বোঝা যায়। একদিকে ক্ষতি, অন্যদিকে ক্ষরণ। দুটোই অন্তরে, তাই বাইরের পার্থিব ছন্দ কোনোভাবেই বিঘ্নিত হয় না - সবকিছুই কতো স্বাভাবিক, কতো সাজানো, কতো গোছানো। ভাঙাচোরা ভেতরটায় পড়ে থাকে শুধু আক্ষেপ। অপচয়ের আক্ষেপ, ক্ষতচিহ্নর আক্ষেপ, বে-হিসেবীর আক্ষেপ। প্রতিটি ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলে তার নিজস্ব ইতিহাস, অপচয়ের আখ্যান। মনে মনে ভাবি 'কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়'...

বাইরে একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি নাকি স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়! বৃষ্টির ছন্দের মধ্যে স্মৃতি ফিসফিস করে বলছে "ক্ষমা করে দিও"।

কিছু কিছু ক্ষত থাকে যা ক্ষমা সারিয়ে তোলে না। ক্ষয়, ক্ষত, ক্ষতি, ক্ষরণ, ক্ষমা... জিন্দেগী হ্যায়, বহেনে দো...

সুমন সিনহা
২৩ /০৭ /২০২৪


Sunday, June 30, 2024

এলোমেলো ভাবনা - ১০

হঠাৎ হঠাৎ মনের মধ্যে উৎপটাং কিছু চিন্তাভাবনা এসে ভীড় করে। কিছুদিন ধরে হাফ মানে ওই অর্ধেক শব্দটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক শব্দের অর্থ কেমন করে যে বদলে যায়! ছোটো বেলায় হাফ শব্দটির মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি লুকিয়ে থাকতো কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে হঠাৎ করেই একদিন আবিষ্কার করলাম হাফ শব্দটার মধ্যে একটা কঠিন নির্মমতা, একটা অবহেলা, একটা উপেক্ষা, একটা বিষন্নতা লুকিয়ে আছে।

প্রথম সাইকেল চালানো শেখা মানে আমাদের ছোটোবেলায় হাফ প্যাডেল শেখা ছিলো। সেই হাফ প্যাডেল সাইকেল চালানো শিখে যে উন্মাদনা, যে আনন্দ ছিলো, ফুল প্যাডেল শিখে বোধহয় কারোরই সেই মাত্রায় উন্মাদনা হয় নি কারণ সাইকেল শেখা মানে আমাদের ছোট বেলায় হাফ প্যাডেল শেখাই ছিলো। হাফ প্যাডেল শিখে গেছি মানে সাইকেল চালানো শিখে গেছি আর কি।
ছোটো বেলায় বাড়িতে যেদিন ডিমের ঝোল রান্না হতো, হাফ ডিম দিতো আমাদের। একটা ডিমকে হাফ করে একটা ভাগ আমার, আর একটা ভাগ দিদির। সেই ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে কখনো মন খারাপের ব্যাপার থাকতো না, বরং শেয়ার করার মধ্যেও যে একটা তৃপ্তি থাকে, সেটা বোধহয় অজান্তেই মনের ভেতর ঢুকে গেছিলো।
ছোটো বেলায় মা বাবার সাথে ট্রেন বা বাসে যখন কোথাও যেতাম, হাফ টিকিট কাটা হতো আমার জন্য। নিজেকে এক ধরণের প্রিভিলেজড্ই মনে হতো তখন।
হাফ জামা, হাফ প্যান্ট, হাফ টিকিট, হাফ প্যাডেল, হাফ ডিমের মতো আরো কতোরকম হাফ নিয়েই জীবনটা কতো সুন্দর, সরল ছিলো।
আর একটু বড়ো হয়ে যখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ছি, তখন তেজস্ক্রিয় পদার্থের হাফ লাইফ শিখলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিলো। খুব সহজ কথায় বললে the half life of a radioactive element is the time it takes for half of the element to decay. কিন্তু যতোই ইন্টারেস্টিং হোক না কেনো, হাফ লাইফ শব্দটি একটা ক্ষয়ে যাওয়া বোঝায়! 
তারপর বাজারে একদিন চেতন ভগতের একটা বই বেরোল। নাম হাফ গার্লফ্রেন্ড। নামটা শুধু অদ্ভুত লেগেছিলো তাই না, বড় অবাকও হয়েছিলাম। বইটা যখন সিনেমা হয়েছিল তখন চেতন ভগতকে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন - এরকম নাম কেনো দিলেন বইটির। চেতন ভগতের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিলো "Because that's what most of the Indian men get". গার্লফ্রেন্ডও (বা বয়ফ্রেন্ডও) হাফ হয়! কিজানি  হাফ বউও হয় কিনা!! 
আরো যখন বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হলাম, হাফ জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পর দেখলাম সম্পর্কগুলোও হাফ-হার্টেড। কিছুটা সময় কাটানো, কিছুটা শৌখিনতা ও নানা রকম প্রয়োজনের তাগিদে কতজন কতোজনের সাথে যোগাযোগ রাখে, সম্পর্ক তৈরী করে। সবকিছুই কেমন যেনো হাফ হাফ। কোনো দায় নেই, কেমন যেনো আজ আছে, কাল নেই টাইপের। একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার, মুহূর্তেই যার অস্তিত্ব। 
রবি ঠাকুরের "শুধু যাওয়া আসা" গানটার চারটে লাইন আজকাল মনের মধ্যে সবসময়ই অনুরণন তোলে।
"হৃদয়ে হৃদয়ে, আধো পরিচয়
আধোখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়
লাজে ভয়ে ত্রাসে, আধো বিশ্বাসে
শুধু আধোখানি ভালোবাসা"।
এরকম ভাবেই কতজন অর্ধেক পরিচিত হয়েই একটা জীবন কাটিয়ে দিলো !! অর্ধেক কথা বাকিই থেকে গেলো!! হাফ বিশ্বাস, হাফ ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকা...
যাকগে, এই সবকিছু নিয়েই হাফেরও বেশি জীবন কাটিয়ে দিয়েছি।

সুমন সিনহা
৩০/০৬/২০২৪


Monday, April 22, 2024

শঙ্খ ঘোষ

চিওপ্রিয় ঘোষ তখনও শঙ্খ ঘোষ হয়ে ওঠেন নি। সেটা ১৯৫২ সাল। খাদ্যের দাবি তে আন্দোলন নিয়ে রাস্তায় সাধারণ মানুষের মিছিলে পুলিশের গুলি ও এক বিয়ে - ঠিক - হয়ে - যাওয়া তরুণীর মৃত্যু (সম্ভবত চার জন মারা গিয়েছিলেন) ও তার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তরুণ চিত্তপ্রিয়কে রোমান্টিক অবসেসন্ থেকে বাস্তবের রুক্ষতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। তাঁর উদ্ধত কলম থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাংলা কবিতার এক অনবদ্য কালজয়ী সৃষ্টি - 

"নিভন্ত এই চুল্লীতে মা / একটু আগুন দে / আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি / বাঁচার আনন্দে।
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে / যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে / বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে / দিয়েছে পথ, গিয়ে।" 
সমাজবিমুখ আত্মমগ্নতা নাকি "বিশুদ্ধ শিল্প "- এই দ্বৈরথের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে তিনি তৈরী করেছিলেন কবিতার নিজস্ব ঘরানা যেখানে মানবিক স্পর্শটুকুই বারে বারে হৃদয় ছুঁয়ে গেছে পাঠক - পাঠিকাদের। দাক্ষিণ্যের নেশা বা প্রসাদ পাওয়ার লোভ - কোনকিছুই শঙ্খ বাবু কে তাঁর অবস্থান থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি। 'বাবরের প্রার্থনা'র পর গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে। তবুও কোনো কালেই কোনো শাসকের কাছে তাঁর কলম বন্ধক রাখেন নি। ২০০৮ এর নন্দীগ্রাম ঘটনার পর একই রকম দৃঢ়তায় তিনি অবিচল ছিলেন। আমরা আবার সাক্ষী থেকেছি তাঁর চেতনার, মননের ও কবিতার মানবিক টানের - 
" আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে/ যারা প্রতিবাদি তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে/  গুলির জন্য সমস্ত রাত সমস্ত দিন খোলা/ বজ্রকঠিন রাজ‍্যে এটাই শান্তিশৃঙ্খলা/ যে মরে মরুক অথবা জীবন, কেটে যাক শোক করে/ আমি আজ জয়ী সবার জীবন দিয়েছি নরক করে"। 
পরিবর্তনের ধাক্কায় ভেসে যাওয়া একটা জাতির "সুশীল সমাজ" যখন মঞ্চ ভাগাভাগির কুৎসিত প্রতিযোগিতায় ও পুরস্কারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যস্ত, তখনও তিনি সযত্নে সেই ভিড় থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। বরং সাম্প্রতিক পৌরভোট নিয়ে সুবিধেবাদী বাঙালি বিবেক কে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন - 
"যথার্থ এই বীরভূমি / উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে এসে/ পেয়েছি শেষ তীরভূমি / দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে খড়গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।"
কোভিড আতিমারীতে গতবছরই থেমে গেছে বাঙালি সমাজের বিবেকের শঙ্খধ্বনি। দুদিন আগে চলে গেলো শঙ্খ বাবুর জন্মদিন। চিরকাল কাব্যাদর্শে স্তিতধী মিতভাষী শঙ্খ বাবু পরিমিত ও পরিশীলিত শব্দচয়ন ও আবেগঘন উচ্ছাস বর্জন করে কবিতার যে স্বতন্ত্র ধারা তৈরী করেছিলেন, কবিতার শিল্পে উত্তরণে তা কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি, বরং তাঁর কবিতার মানবিক অভিঘাত মানুষ কে আরো বেশি নাড়া দিয়েছে। তাঁর জীবন, দর্শন ও সৃষ্টি বারে বারে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়েছে "তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়"।

সুমন সিনহা
০৭/০২/২০২২



Saturday, April 13, 2024

Random thoughts - 9

Prologue...

Nowadays quite often I find time hanging heavy on my hand. Random thoughts cripple my mind. Looking back, I find that if my past few years' life be plotted in a two-dimensional canvas, there is a series of sky scrapers on either side of the horizontal. Let me pen down the monologues scattered over the mind of a suburban boy of mid-forties.

Monologue...

Over the years, you learn that the person who is dearest to your heart can knock you down any time, can replace you in no time. You learn to enjoy being alone.

After a while, you learn that the person for whom you take so much risk by going against the current will simply dump you one fine morning. You learn resilience.

Someday you will discover with utter surprises that all the promises are empty and listening to different excuses at different times, be it full of contradictions, is the only reality. You learn to accept the reality.

With time you learn that the person whom you expressed your feelings and emotions without any hypocrisy will use it as a tool for torturing you and will feel intense pleasure by playing with your emotions which was so pure, genuine and honest to you. You learn to accept it as a gift in return.

Over the years, you learn that holding someone's hand in privacy with expressive eyes is just casual signifying nothing. At the same time, hugging, embracing, sharing private moments with someone else in and away from public, intimate texting and always satisfying and entertaining that someone else willingly in every possible way is just a part of social interaction, no matter how ugly it is. With the flow of time, you simply go on witnessing helplessly that someone else has become someone special with exchange of intimate and personal chats, dearly interaction and regular meet on this or that occasion. You begin to realize the meaning of replacement and that's what you deserved.

With the flow of time, you learn that relationship of any kind is nothing but a need and that very need changes with time in various forms. You realize that the depth of a relationship is an utopian concept. You begin to learn that care, concern and possessiveness for a person are something to be laughed at in this consumerist world. You learn that giving importance to someone translates to being ignored.

After a while you learn that what you thought to be your most precious possession never belonged to you and you begin to accept that being deceived, being abandoned is the way of life.

You learn that it is the money, the market value, the glamour and the show off that decide your worth and value to someone. You begin to accept with the grace of an adult that you are the most misfit person in this post truth age to survive. You do not deserve to love someone, to be loved by someone in this lustful society where thoughtless aspirations, unlawful ambitions, illicit relations and unethical activities are the new normal. You begin to understand your worth and realize how much you are prioritized, desired and understood by others.

You learn that the person whom you trust most will just give you a sheer fuck and you learn to endure being fucked.  And you learn that you really can endure because there is no other alternative left for you.

Let people be wrong about you. Let people take you amiss. Let people blame you. Let people think you are judgmental. Let people believe you live with inhibitions. Let people think you indulge in negative thoughts. Let people think that you enjoy sort of masochistic delight. Let them think what they want to think, how they want to think. After all, the feelings are yours only. It is you who endured everything. You begin to understand that the lessons you learnt add to your experience, add to your maturity. And you learn to move on with your head up and your eyes ahead, without changing yourself.

Epilogue...

There was a time when I used to be afraid of reaching the dry age of cynicism. And now I discover myself being completely confounded that I have reached the age of cynicism, the age of nihilism. Let me be alone, far away from the madding crowd, far away from the majority. Let it be the bliss of solitude. "The struggle of memory against forgetting" is the only inevitable. I am now tired of seeing my own defeat. I barely recognize myself now.

 Suman Sinha

13/04/2024

 

My recitations

I love reading books and reading poetry is a kind of addiction to me. It gets me emotionally invested. Recitation, to me, is an old habit that refuses to die with time. I was trained in reciting in my boyhood and adolescence, although for a short period. I used to recite regularly then. As I grew older, practising recitation became irregular. However, I keep going back to it as and when I feel up to it. It helps me stay calm.

Although I am not a regular elocutionist, let this place be the platform for sharing with you my recitations that are dear to my heart. Unshared likings scarcely bring happiness and hence tasteless.

Here's the link to my YouTube channel. Please listen to it at your convenience and if possible, subscribe to it.

Click on

P.S. The recitations are recorded ordinarily and unedited. The audio quality is not of professional level.


Monday, April 8, 2024

বৃত্তের বাইরে

দোলা কখন কোথায় যায়, কি করে, কিছুই আর উজান জানতে পারে না এখন।
উজান নিজের ঘরে শুয়ে একটা প্লেলিস্ট চালিয়ে গান শুনছে। সেই মুহূর্তে উজানের প্রিয় একটা গান চলছে... 'আমি তো ছিলাম বেশ নিজের জগতে / আনাগোনা ছিলো শুধু চেনাজানা পথে / খেলার সাথীর হাতে হাত রেখে খেলা / খেলতে খেলতে কেটে গেলো ছেলেবেলা / এখন হঠাৎ কেনো আনমনে ভাবি / এসেছে অবাক করা জীবনের দাবি।'
উজান অবাক হয়ে ভাবছে যে কখনো কখনো জীবন সত্যিই খুব অবাক করা দাবি নিয়ে হাজির হয়।
আমাদের চারপাশে ঘটে চলা কত ঘটনাই আমরা জানতে পারি না। কিছু ঘটনাপ্রবাহ একদম অপ্রত্যাশিত যার জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি থাকে না। কিন্তু সেসব ঘটনার অভিঘাত কাউকে কাউকে জীবনের মূল্য দিয়ে চোকাতে হয়। গড়পড়তা চোখে আপাত-নিরীহ সেসব ঘটনাপ্রবাহে অতি সাধারণ, বাজারদরহীন উজানের অনুভূতিগুলোই অবশ হয়ে গেছে। ঘটনাগুলি বহুমাত্রিক যার একদিকে আছে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে নীতিবোধশূন্য, টাকাপয়সার বৈভব দেখানো কিছু মানুষের ব্যবসায়িক ধান্দাবাজি, অনৈতিক সুবিধেভোগ, ফুর্তি ও বেলেল্লাপনা আর অন্যদিকে আছে দোলার চূড়ান্ত ভন্ডামি, নিপুণ অভিনয় ক্ষমতা, অসম্ভব চালাকি, নিজেকে মহৎ ও নির্দোষ প্রমাণ করার প্রাণপণ হাস্যকর প্রয়াস এবং যেকোনো কিছুর বিনিময়ে কিছু ব্যক্তিবিশেষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও লোভ।
সাধারণতঃ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই একটা পরিচিতির বৃত্ত থাকে। এই সামাজিক অবস্থান মূলতঃ নির্ধারিত হয় অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক বিচরণের ক্ষেত্র দিয়ে এবং কিছুটা রাজনৈতিক বোধও থাকে। অর্থাৎ একটা মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে পরিচিতির বৃত্ত তৈরী হয়। যেমন, বিত্ত দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে মাপা যায় না, মধ্যবিত্ত মূলতঃ একটি মানসিকতা যার সুবাদে আমরা সবাই সেই চেনা বৃত্তের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করি। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন যারা সেই পুরোনো বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতার নতুন একটি বৃত্তে খুব অনায়াসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং সেই বৃত্তের মধ্যে ঢুকে গর্ব ও অহংকার বোধ করেন। কিসের অমোঘ নেশায় মানুষ জেনেবুঝে, সচেতনভাবে, খুবই দ্রুত, কোনোরকম আক্ষেপ বা অনুশোচনা ছাড়া সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানের বৃত্তে অনায়াসে বিচরণ ক'রে বেলাগাম জীবন ও যাপনে স্বেচ্ছায় অভ্যস্ত হয়ে গর্ব বোধ করেন, অন্যদের কাছে জাহির করেন এবং ফিরে আসবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে স্বেচ্ছায় আরো বেশি নিজেদের সেই বৃত্তের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তা উজানের মতো মধ্যমেধার লোক বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু যেটা বুঝতে পেরেছিল, সেটা হলো পুরোনো বৃত্তে বিচরণ তাদের মুখোশ, নতুন বৃত্তে বিচরণের নেশা তাদের মুখ।
ইংরেজিতে 'হার্ড মেন্টালিটি' ব'লে একটি শব্দবন্ধ আছে যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'দলে ভিড়ে যাওয়ার মানসিকতা বা প্রবণতা'। উজানের মধ্যে সেটি একেবারেই ছিলো না। আরো অনেক দোষ উজানের। যেমন তথাকথিত "ক্লাস", "স্ট্যাটাস", "ডিগ্রি" ইত্যাদিকে একেবারেই সে পাত্তা দেয় না। সে বিস্কুটকে কিছুতেই বিস্কিট বা কুকিজ বলতে পারে না!! মদ্যপানকে ড্রিংক্স নেওয়া বলতে পারে না। মানে বলে না আর কি। পয়সার দেমাক ও বৈভব দেখানো লোকজনদের, যারা অনেকের চোখেই "হাই সোসাইটি", তাদের থেকে উজান সচেতন ভাবে দূরত্ব রেখে চলে এবং যেকোনো কিছুতেই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারে না। উল্টে অন্যদের সাথে সুর মেলাবার পরিবর্তে সে নানা প্রশ্ন করে। উচ্চাকাঙ্খার উদযাপন যেখানে হয় এবং সেই উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের প্রচার করে যারা আত্মসুখ ও গরিমা অনুভব করেন, দুটোর থেকেই উজান অনেক দূরেই বিচরণ করে। সে কখনোই সবার প্রিয় হতে চায় না। সস্তা জনপ্রিয়তার হাততালি কখনো উজানকে আকৃষ্ট করে না। ব্যক্তিপুজো বড় অপছন্দ উজানের। এসব কোনো "কোয়ালিটি" না থাকার কারণে উজানকে বিশেষ কেউ পছন্দও করে না, গুরুত্বও দেয় না। ব্যক্তিগত সীমানার পরিধিতে হাতে-গোনা কিছুজনকে নিয়েই ছিলো উজানের জীবন। তার মধ্যে দোলাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতো উজান। তার অনেক কারণও ছিলো, সেসব নেপথ্যের ঘটনা অলিখিতই থাক।
জীবনে ঘটবার মতো ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঘটে। সেরকমই অপ্রত্যাশিত ছিলো উজান ও দোলার হঠাৎই আলাপ। কিছুটা নাটকীয়ও, উজান ঘটনাচক্রে দমকা হাওয়ার মত হাজির হয়েছিলো। পরিস্থিতি সেই আলাপ পরিচয়কে তরাণ্বিত করেছিলো আরো। দোলা তার একঘেয়ে, দমিত ও বদ্ধ জীবনের নানা কাহিনী উজানের সাথে শেয়ার করতো আর উজান বিস্ময়ে সেসব শুনতো ও বিশ্বাস করতো। সেই বিশ্বাসের মধ্যে একটা শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা ছিলো। গুমোট দিনের শেষে আচমকা এক পশলা বৃষ্টির পর ঘরের জানালা খুলে দিলে সেই হাওয়ায় যে একটা অননুভূত পরম তৃপ্তির অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতির রেশ নিয়েই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। ক্রমে সেই জানালা দিয়ে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, পড়াশোনা, সিনেমা, আধুনিকতা ইত্যাদি নানাবিষয়ে খোলা হাওয়ার স্রোত বইতে শুরু করে। অনাস্বাদিত সেই ভালো লাগার মুহূর্তগুলো উজান কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতো না। কিন্ত সেই স্রোতের অর্থ দুজনের কাছে ছিলো ভিন্ন। উজান অচিরেই বুঝতে পারে যে একজনের স্রোতের অনুকূলে বয়ে যাওয়ার স্বভাব ও অন্যজনের স্রোতের প্রতিকূলে যুঝবার চেষ্টা কখনোই একই কেন্দ্রাভিমুখী হতে পারে না। তবুও উজান দোলার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারতো না। পরিস্থিতি বা পারিপার্শ্বিকতা একটা কারণ ছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রথম পরিচয়ের সেই দিনগুলোতে দোলার ডাকের মধ্যে একটা উষ্ণতার আহ্বানও থাকতো। দুজনেই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা কথাবার্তা বিনিময় করতো।
দোলা তার জীবনের নানারকম বিশ্রী ও তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উজানকে বলতো। যে বা যারা সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণ, তাদের কথাও বলতো। ক্রমে উজানের প্রথম ও প্রধান প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল দোলা। সময় বহমান আর সেই বহমানতা একমুখী নয়। উজান খেয়াল করতো যাকে বা যাদের নিয়ে দোলার এত অভিযোগ, দোলার এত তিক্ত অভিজ্ঞতা, তার বা তাদের সাথে মেলামেশায় দোলা খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং আগ্রহীও। উজানের খটকা লাগার সেই শুরু। দোলার কথাবার্তা থেকে উজান এটা বুঝতে পারতো যে দোলার পয়সাওয়ালা লোকজনদের প্রতি, ভোগবাদী জীবনের প্রতি, প্রাচুর্যের প্রতি, বিলাসবহুল জীবনের প্রতি একটা সহজাত আকর্ষণ ছিলো। তাই দোলার জীবনে প্রায়োরিটি ছিলো অন্য কিছু। প্রাচুর্যের সেই মোহময় জীবন উপভোগ করার জন্য দোলার তিক্ততার সঙ্গীসাথীদের দরকার ছিলো। প্রয়োজন যার বা যাদের দ্বারা মেটে, তাদের পেছনে সময় ব্যায় তো করতে হবেই, তাদের ডাকেও সাড়া দিতে হয়। তা না হলে প্রাচুর্যের হাতছানি অধরাই থেকে যায়। সেদিক থেকে উজান একদমই লাভজনক ছিলো না। কিন্তু দোলার কথা বলার একটা লোকের বড় প্রয়োজন ছিলো সেইসময় আর স্বীকৃতিহীন উজান ছিলো দোলার সেই প্রয়োজন শুধু। উজান বুঝতে পারতো যে দোলার এই প্রয়োজন সাময়িক। দেখাশোনা আর চেনাজানার মধ্যে একটা বড় ফারাক আছে। দোলা দেখাশোনার মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে চাইতো সবকিছু। তাই উজান নিজের স্বভাববশত দোলার থেকে দূরত্ব রেখে চলার চেষ্টা শুরু করে। হয়তো কিছুটা পেরেওছিল সাময়িক। কিন্তু সবকিছু উজানের হাতে ছিলো না। আসলে এমন কিছু সামাজিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিকতা বা পরিস্থিতি কখনো কখনো তৈরী হয় যে চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। উজান সেরকমই একটি অবস্থার ঘুর্ণিতে পাক খাচ্ছিল আর দোলা সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে যাচ্ছিল। দোলার বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক স্টাইল ছিলো যে কপটতা টের পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। ঠিক যতোটুকু ও যেভাবে উজানকে প্রয়োজন ছিলো, দোলার কথাবার্তা বা মেলামেশা ঠিক ততটুকুই মাপা ছিলো। দোলা অনেককিছুই উহ্য রেখে দিতো কিন্তু উজানের কাছে কোনোকিছুই গোপন থাকতো না। কিন্তু ওই যে কথায় বলে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু। তাই সুযোগ ও সুবিধে মতো দোলার মেলামেশাকে, সময় ও ক্ষেত্র বিশেষে দোলার উপেক্ষাকে উজান নিজেরই ভুল ভাবতো। আসলে ভুলটা ছিলো অন্য জায়গায়। দোলাকে গুরুত্ব দিতে দিতে উজান নিজেকে বড় সহজলভ্য করে তুলেছিল। আর সহজলভ্য যেকোনো কিছুই বড় সস্তা হয়, কোনো দাম থাকে না... সেখানে বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখাটা একধরনের কাল্পনিক বিলাসিতা মাত্র!
একটা সময়ের পর থেকে উজান দেখে যে দোলা ভীষণই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের চেনা কথাবার্তার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে, চালচলন বদলে যাচ্ছে, পরিচিতির বৃত্ত পাল্টে যাচ্ছে। অনেক ঘটনাই লুকিয়ে যাচ্ছে, অনেক ঘটনাই নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে লঘু করে উপস্থাপন করছে। অজুহাত দেওয়াটা নিয়মে দাঁড়িয়েছে। অন্যদের নাম নিয়ে নিজের সীমাহীন প্রশংসা করে যাচ্ছে। নতুন বৃত্তে তার কতো গুরুত্ব বা তাকে কতো পাত্তা দেওয়া হয়, তাকে বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসবার জন্য অন্যরা কতো জোরাজুরি করে, তার গুণের জন্য তাকে কতো আপন করে নিয়েছে, তার গুণের কতো কদর করে, সে কতো জনপ্রিয়, কিছু ব্যক্তিবিশেষ তাকে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দেয় যা আর অন্য কাউকে দেয়না - এসব শোনা উজানের প্রাত্যহিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দোলার কাছে সেটা সবকিছু "শেয়ার" করা ছিলো!! নতুন বৃত্তের লোকজনদের কত "কোয়ালিটি", গাড়ি বাড়ি সহ তাদের বৈভবের যাপন, যেনতেনপ্রকারেণ তাদের নির্লজ্জ প্রচার ও গুণগান, ব্যক্তিবিশেষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার অহংকার ও গর্ব- এসবও উজানকে শুনতে হতো। শোনাটাই উজানের কাজ ছিল, কোনোরকম প্রশ্ন বা আলোচনায় অলিখিত নিষেধ ছিলো। আরো আশ্চর্যজনক ছিলো যে, যার বা যাদের সম্পর্কে একদিন দোলা ভীষণ রকম তিক্ত বা মন্দ কথাবার্তা বলতো, যার বা যাদের জন্য দোলা নিজের জীবনের বারোআনাই নষ্ট গেছে বলে দাবী করতো, তারা যে কতো "কোয়ালিটির" অধিকারী, তারা যে কতো মহৎ, সেসবও উজানকে শুনতে হতো। উজানের অবস্থা হয়ে উঠেছিলো বড় অসহায়, না পারতো দোলাকে উপেক্ষা করতে, না পারতো এড়িয়ে যেতে। এড়িয়ে যেতে চাইলে উজানকে অভিযোগ বা দোষারোপ আর যোগাযোগ রাখলে আরো বেশি দোষারোপ!! আসলে নতুন বৃত্তে নতুন জীবনের এসব গল্প শোনাবার জন্য দোলার তখন আবার কাউকে খুব প্রয়োজন ছিলো। পুরোনো বৃত্তে নতুন জীবনের গল্প দোলার "ইমেজ" ধরে রাখবার পক্ষে অসুবিধেজনক ছিলো। সঙ্গত কারণেই দোলা উজানকে বেছে নিয়েছিলো কারণ উজান না ছিলো নতুন বৃত্তে, না ছিল পুরোনো বৃত্তে... বৃত্তের বাইরে ছিলো উজানের অবস্থান।
কেনোই বা দোলা উজানকে সব কথা বলতো বা বিভিন্ন ব্যাপারে উজানের মতামত চাইতো, কে জানে!! কিন্তু উজান খেয়াল করতো যে মতামত দিলেই দোলার নিদারুণ অবজ্ঞা ও অবহেলা। কিছুটা ব্যঙ্গও থাকতো। উজান দেখতো যে নতুন বৃত্তের কারোর সাথে উজানের পরিচয় সযত্নে এবং সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতো দোলা। অথচ নতুন বৃত্তে দোলার বাজারদরের গল্প উজানকে যেভাবেই হোক শোনাতে হবে। প্রথমদিকে উজান খুব অবাক হতো, কিছুই বুঝতে পারতো না। শুধু দোলার বদলে যাওয়াটা বুঝতে পেরে তাকে আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করে যেতো। শুধু দোলার কথা ভেবে নানারকম প্রশ্ন করে যেতো। কিন্তু নতুন বৃত্তে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার পক্ষে দোলার অজুহাতের বন্যাও উজান অবাক হয়ে আবিষ্কার করতো। উজান খেয়াল করতো যে নতুন বৃত্তের আকর্ষণ এতই বেশি ছিলো দোলার জীবনে যে টাকাপয়সা, গাড়িভাড়া ইত্যাদির পেছনে দোলা দরাজ হাতে খরচা করতো। মাঝে মাঝেই উজানের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রাখতো না। বলা বাহুল্য, সে দোষও উজানের বলেই উজানকে শুনতে হতো কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনার পরেই অবধারিত ভাবে উজানকে সেটা শোনাতে হবেই, আর তার সাথেই যোগ করতো উজান যোগাযোগ রাখেনি বলেই সে আগে থেকে কিছু জানাতে পারে নি! আসলে উজানকে কিছু জানাবার কোনো দায় কখনোই ছিলো না দোলার। এই নতুন বৃত্তের লোকজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার, তাদের কাছে যাওয়ার জন্য দোলার সঙ্গীসাথীও ছিলো। আশ্চর্যজনক ছিলো যে, এই সঙ্গীসাথীদের সম্পর্কেই দোলা তার ভীষণই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উজানের সাথে একদিন শেয়ার করতো! আর উজান সেসবই বিশ্বাস করতো! নানা ঘটনায় উজান বুঝতে পেরেছিল যে সেই সঙ্গীসাথীরাই দোলার জীবনে সবকিছু, উজানের কোনো দাম নেই দোলার জীবনে। এমনকি দোলার ব্যক্তিগত স্বীকৃতিও ছিলো না। উজানের সাথে যোগাযোগ রাখাটা ক্রমে দোলার পক্ষে খুবই অসুবিধেজনক হয়ে পড়ছিল, দোলার সঙ্গীরাও চাইতো না। দোলাও আর চাইতো না! দোলা তার স্বভাবসিদ্ধ শৈল্পিক কথাবার্তার মাধ্যমে সেটা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিতো। অবজ্ঞা, অবহেলা, উপেক্ষার সাথে যোগ হলো তুলনা, অন্য পুরুষদের সাথে উজানের তুলনা... এরপর তাচ্ছিল্য - "সাইকোলজিকাল টরচার"... উজানের বেশ কিছু জায়গায় যাওয়া বন্ধ করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা। দোলার চারপাশে তখন বৈভবের ঝোড়ো হাওয়া, বিত্তের মিষ্টি গন্ধ, ব্যক্তিবিশেষের সাথে ঘনিষ্ঠতার উন্মুক্ত অহংকার, বৃত্তের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে দোলা। খোলা বাজারে নিজেকে বিক্রির প্রতিযোগিতা - যার যেমন চাহিদা, তেমন ভাবে দাম দিলেই হলো!
পোশাকআশাক, সাজগোজ ও আদবকায়দায় রপ্ত হওয়া, নতুন বৃত্তে ভীষণই দ্রুত আপন হয়ে যাওয়া ও অন্যদের আপন করে নেওয়া, তাদের সীমাহীন প্রশংসা, নির্দিষ্ট কিছু লোকজনের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্মাণ, ব্যক্তিবিশেষের স্তুতি ইত্যাদি দিয়ে যা শুরু হয়েছিলো, ক্রমে তা গড়াতে লাগলো নিয়মিত "মিট", "গেট টুগেদার", "পার্টি" , "ড্রিংক্স", "খাও - পিও - জিও" - এর জীবনে। দোলা উড়ছে তখন। উজানকে সময় দেওয়ার সময় নেই, অন্য কোথাও সময় দেওয়া আছে, নানা "ইনভলভমেন্টস", নানা "কমিটমেন্টস"-এ দোলা ভীষণ ব্যস্ত। এরপর এলো মধ্যরাতের "পার্টি"। ভোগ, বিলাস, ফুর্তির জীবনে গভীর রাতের আলোআঁধারির মায়াজালে নাচা-গানা, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মদ খাইয়ে দেওয়া, ব্যক্তিবিশেষের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী থেকে নেশাতুড় রাতে গরম পানীয়র সাথে নরম যৌনতার উদযাপন - বেসামাল কিন্তু হিসেবী পদক্ষেপে বৃত্তের কেন্দ্রে পৌঁছাবার অশ্লীল আনন্দ। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের খোলা বাজারে দোলা উত্তাপ খুঁজে পায় অন্য পুরুষের বাহুলগ্না হয়ে। উজান বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে আবিস্কার করে পোস্টট্রুথ যুগে 'ভীষণ আদরে বেঁচে থাকে প্রেম নতুন কোনো ঠিকানায়'। শক্তি চাটুজ্জ্যে লিখেছিলেন '... পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে... মধ্যরাতে ফুটপাথ বদল হয়...' আর উজান অবাক হয়ে দেখেছিল মধ্যরাতে সম্পর্কের হাতবদল হতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিপি বদল হতে...। মালিক যখন পুরুষ হয়ে যায় তখন 'গোপনীয়তার মালিকানা' থাকে না। মালিকের নির্দেশ তখন পুরুষের আবদার হয়ে যায়। মার্কামারা মাতালরাও তো কারোর না কারোর পুরুষ হয়!!
এতো সবের পরও উজানের কাছে দোলার নিজেকে "ডিফেন্ড" করার চেষ্টা উজানকে হতবাক করে দিয়েছিলো। নিজের কাছেই নিজের পরাজয় দেখতে দেখতে উজান তখন বিধ্বস্ত, স্বাভাবিক জীবনের মূলস্রোত থেকে বহু দূরে। তখনও দোলা কি স্বাভাবিক! বিভিন্ন ঘটনাকে "জাস্টিফাই" করতে অবলীলায় একের পর এক মিথ্যে বলে যাচ্ছে, অন্যদের নামে দোষ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনোরকম আফসোস বা অনুশোচনাবোধ নেই, নিদেনপক্ষে লজ্জাবোধটুকুও নেই। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিতভাবে নিজের দরকার, প্রয়োজন, কার্যসিদ্ধি, লাভ, বিলাসিতা, শখ বা উচ্চাকাঙ্খার জন্য দোলা যেকোনো জায়গায় যেকোনো কারোর সাথেই যে সবকিছুই করতে পারে, সেটা খুব নগ্ন ভাবে প্রকট হয়ে পড়েছিলো। তবুও উজানের কাছে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার কি চক্ষুলজ্জাকর প্রয়াস! উজান যখন একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করলো, কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না দোলা, এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গ বদলানোর স্বভাবসিদ্ধ ও দক্ষ ভঙ্গিমাতে একটা সত্য ঢাকতে গিয়ে হাজারো মিথ্যে ফাঁকফোকড় দিয়ে বেরিয়ে এলো, লুকানোর আর কোনো জায়গা থাকলো না। "ডিফেন্ড" করতে গিয়ে নিজেকে আরো খেলো করে চলেছে দোলা, একদিন উজানের কাছ থেকেই শোনা "বিশ্বাস", "শর্ত", "ভালোবাসা" ইত্যাদি শব্দের কুৎসিত প্রয়োগ একনাগাড়ে শুনে চলেছে উজান। তখন সম্পূর্ণ অন্যরূপে দোলা। যে ভাষায় যে চূড়ান্ত অপমান উজানকে হজম করতে হয়েছিলো, তা ছিলো উজানের কল্পনারও অতীত। উজানকে আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা বানাতে দোলার সময় লেগেছিলো মাত্র একটা মুহূর্ত। অনুভূতি অবশ হয়ে গেলে আঘাতের তীব্রতা থাকে না বোধহয়। দোলার অকপট স্বীকারোক্তি ছিলো "সম্পর্কটা ভালো ভাবে শেষ করতে চেয়েছিলাম, এতো খারাপ ভাবে হবে ভাবিনি"। সম্পর্কও শেষ হয় ভালো ভাবে! শেখার কতকিছু বাকি ছিলো উজানের। যাক, দোলা যে সম্পর্কটা শেষ করতে চাইছিলো, সেটা অন্তত পরিষ্কার করেছিলো। সেটাই অনেক মূল্যবান শিক্ষা ছিলো উজানের কাছে।
জনপ্রিয়তার নেশা, উচ্চাকাঙ্খার নেশা, প্রাচুর্যের নেশা বড় সাংঘাতিক। বিত্তশালী পুরুষের গা ঘেঁষে থাকতে না পারলে এসব নেশা জমে না। বৃত্তের পরিধিতে অবস্থান করলে কেন্দ্রের থেকে দূরত্ব সময়ের সাথে সমান থেকে যায়, কখনো কমে না। তাই বেছে নিলো সেই পুরুষকেই যে পয়সা উড়িয়ে বৃত্তের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে। সেই নতুন পুরুষের সাথে দোলার হাসিমুখে আরাম আর তৃপ্তির নানান মুহুর্তের যুগল ছবিতে যখন সভাকক্ষ হাততালিতে ফেটে পড়ছে, উজান তখন সভাকক্ষ থেকে অনেক অনেক দূরে সেন্ট্রিফুগাল ফোর্সের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বৃত্তের বাইরে ছিটকে পড়ে আছে। আধুনিকতার যে হাওয়ায় দোলা আর উজানের একান্ত ব্যক্তিগত একটি সম্পর্ক একদিন গড়ে উঠেছিলো, বিত্ত, বৈভব, জনপ্রিয়তা ও পয়সাওয়ালা পুরুষের নেশায় দোলা তাকে নিজের হাতেই মেরে ফেললো।
দোলারা মুখ ও মুখোশের ভারসাম্য সামলে সবার প্রিয় হয়ে জীবনের মূলস্রোতে থেকে জীবন উপভোগ করতে করতে আগামীর দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু স্মৃতি শেকল হয়ে যাদের আগামীকে অতীতে বেঁধে রাখে, দোষ তাদেরই হয়!
গান থেমে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই রাত শেষ হবে। উজান ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো। কোলাহলহীন, আলো ঝলমলহীন অদ্ভুতরকম শান্ত এক পরিবেশে নিস্তেজ, দাপটহীন রাস্তার আলোর মধ্যে দিয়ে যতদূর দেখা যায়, ঝাপসা চোখে উজান সেই নিঃসীম শূন্যতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রইলো।

সুমন সিনহা
২৭/১০/২০২৩

হাটে বাজারে - ১

দেখতে দেখতে প্রায় দশ বছর কেটে গেলো পুণেতে। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যে বাইরে কোথাও কর্মসূত্রে আসতে হবে বা থাকতে হবে, কোনোদিনও ভাবিনি। তবুও আসতে হয়েছিলো। বাধ্যবাধকতা আর কি। এখনও প্রায়ই মনে হয় - না এলেই বোধহয় ভালো ছিলো। এই শহরটার সাথে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারিনি, যোগাযোগটাই তৈরী হয়নি আসলে। তবুও রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে, দোকান-বাজার করতে গিয়ে কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ তৈরী হয়ে যায়। তাদের সাথে ফোনে কথা হয় না বা চ্যাট হয় না বা অনেক সময়ই নিয়মিত দেখাও হয় না। তবুও একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। এই যেমন ধরুন উত্তম বাবুর কথা। ওর একটা ফুচকার দোকান আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই বাঙালি ফুচকা। নান্দেরফাটা থেকে কিছুটা ভিতরে ওর দোকান। পাকা কোনো দোকান নয়, রাস্তার ওপরেই এক ফালি জায়গায় ছোট্ট একটা স্টল মতো আর কি। এই বছর খানেক আগে আমি ওর ফুচকার দোকানের কথা জানতে পারি, তার আগে জানতামও না। জানার পর থেকে প্রায় নিয়মিত আমি ফুচকা খেতে যাই। বহরমপুর বা কলকাতায় থাকতে আমি যে খুব একটা ফুচকা খেতাম, তাও নয়। কিন্তু এখানে এই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে এসে বাঙালি কোনো দোকান দেখলেই কেমন একটা টান অনুভব করি, মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে যেনো কোনোভাবে কানেক্ট করতে পারছি। তাই প্রায়ই অফিস শেষ হওয়ার পর বা কোনো ছুটির দিনে সন্ধ্যা বেলায় চলে যাই উত্তম বাবুর কাছে। কিছুক্ষণ গল্প করি ওর সাথে, ফুচকা খাই তারপর চলে আসি। উত্তম বাবুর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়। মেচেদা, কোলাঘাট এলাকাতেও ওর অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে। পারিবারিক হোটেল ব্যবসা আছে ওদের। মূলত হলদিয়া ডক এলাকেতে ওদের ছোটখাটো হোটেল আছে। প্রায় বাইশ বছর হলো উনি পুণেতে এসেছেন। প্রথমে একটা ফ্রেবিকেশন কোম্পানিতে কাজ করতেন। বছর আষ্টেক হল সেই কোম্পানিটি পুণে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে উত্তম বাবু এই ফুচকার দোকানটি করেন। কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের নানা গল্প উনি করেন, ওখানকার বর্তমান রাজনীতি নিয়েও বলেন। কতো অকপটে, কোনো ভনিতা না করেই সব কিছু বলেন। মুখে সব সময় একটা স্মিত হাসি লেগেই থাকে। কোনো মেকি ব্যাপার থাকে না। কিছুদিন না যেতে পারার পর যখন যাই, তখন এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করেন আমায় "কেমন আছেন? অনেকদিন আসেন নি, ভাবছিলাম কি হলো।" জিজ্ঞেস করার মধ্যে একটা আন্তরিকতা থাকে। বউ, ছেলের খবরও নেন। উত্তম বাবুর তিন মেয়ে। বড় মেয়েটা দেশের বাড়িতেই থাকে। মেজো ও ছোটটি পুণেতেই থাকে। মেজো মেয়েটা পুণেতেই একটা কলেজে স্নাতক পড়ছে এখন। ছোটটা স্কুলে। উত্তম বাবুর বউ বাড়িতেই ফুচকা ভাজেন। তাই ফুচকা গুলোর স্বাদ একদম পশ্চিমবাংলার মতো, এখানকার মতো নয়। উত্তম বাবু তেঁতুল জল বা আলুমাখা দারুণ মুখরোচক ভাবে তৈরী করেন। মশলাগুলো দেশ থেকে আনান। ইচ্ছে করলেই এখান থেকে কিনতে পারেন কিন্তু তবুও উনি দেশ থেকে আনান। একেই বোধহয় নাড়ির টান বলে, ভালোবাসা বলে। কলকাতায় দুটো জায়গায় ফুচকা খুব বিখ্যাত ছিল একসময় - একটা লেকটাউনের মোড়ে আর একটা শ্রীরাম আর্কেডের সামনে বসতো। এখন জানিনা অবশ্য। উত্তম বাবুর ফুচকার মধ্যে সেরকমই স্বাদ পাই অনেকটা। আমি গেলে আমাকে অন্যদের থেকে একটু বেশিই খাতির করেন দেখি, মানে আলুটা আলাদা করে মাখে ছোলা বেশি দিয়ে, লেবুর পরিমাণ ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন, সবসময় দুএকটা বেশি ফুচকা দেন। পুত্রকে নিয়ে গেলে তো কথাই নেই, বেশ কিছু অতিরিক্ত ফুচকা জুটে যায় ওর। কিন্তু পয়সা বেশি দিতে চাইলেও কিছুতেই নেন না। মাঝে মাঝে বিড়ম্বনা বোধ করি একটু। আবার বারবার পয়সা বেশি নেওয়ার কথা বললে ওকে ছোট করা হয়। তাই আর বলি না। একটা অকৃত্রিমতা আছে সম্পর্কটার মধ্যে। এই অকৃত্রিমতা, এই স্বতঃস্ফূর্ততা বড়ো ভালো লাগে আমার। ফুচকা খেতে গেলেই মাঝে মাঝেই আমাকে উনি বলেন "আপনার মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে একটা ফোন করুন তো"। রিং হলেই আমি ওকে ফোনটা দিয়ে দিই। উনি ওর স্ত্রীকে আরো ফুচকা দিয়ে যেতে বলেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম "এটা তো তোমার মোবাইল। তোমার কাছে কখনো থাকে না কেনো? (আমি ওকে তুমি বলেই ডাকি, উনিই বলেছিলেন 'তুমি' করে সম্বোধন করতে)। উত্তম বাবু বললেন "এর আগে দোকান থেকে দুটো মোবাইল চুরি গেছে। মোবাইল টা দোকানে রেখে কাজ করতাম। সবসময় পকেটে রাখা যায় না। কোনো ফোন এলে পকেট থেকে বের করা অসুবিধে। খরিদ্দারদের ফুচকা দিচ্ছি, আলু মাখছি, কোনো না কোনো কাজে সবসময়ই ব্যস্ত থাকি, তাই সবসময় মোবাইল ফোনের দিকে নজর দেওয়া যায় না। কখন যে কে এসে মোবাইলটা তুলে নিয়ে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। তাই আর দোকানে মোবাইল আনি না।" শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। উত্তম বাবুর দোকান বন্ধ করে সব গুছিয়ে বাড়ি যেতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায়। দোকান খোলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। দীর্ঘ সময় মোবাইলের সাথে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই দিব্যি চলে যায় উত্তম বাবুর। আমি হলে কি পারতাম সেটা? উত্তম বাবুদের মতো মানুষ দেখলে এখনও একটা ভরসা হয়। ছদ্ম, মেকি, বড়াই করা, ফাঁপা, বিশ্বাসহীন ভোগবাদী সম্পর্কের বর্তমান জগতে যখন প্রতিনিয়ত হাঁপিয়ে উঠি, তখন উত্তম বাবুর মতো কারোর কাছে গিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারি - এমন প্রিভিলেজই বা কতজন পায়? জীবন তো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একজন বা কয়েকজনের সাথে "সম্পর্ক" রেখে যাওয়ার একপেশে চেষ্টা নয়!!!
নীচের ছবিটি উত্তম বাবুর সাথে। উত্তম বাবুর অনুমতি নিয়েই ছবিটি পোস্ট করেছি।
সুমন সিনহা
২৬/০৩/২০২৪


 


১৪ /০২ / ২০২৪ 

বাবা'র মৃত্যুবার্ষিকী

আজ থেকে আঠারো বছর আগে এই দিনে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। চলে যাওয়াটা আকস্মিক ছিলো, তাই মানসিক প্রস্তুতি কারোরই ছিলো না। তখন আমার গবেষণা জীবনের প্রথম দিক। রাতে হস্টেলে খাওয়ার সময় কাকা'র ফোন "মেজদার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। তুই কি আসতে পারবি বাড়িতে একবার? সেরকম যদিও কিছু নয়, তবুও... "। তার পাঁচ দিন আগেই বাড়ি থেকে ফিরেছিলাম। তাই কিছুক্ষণ দোনামোনা করে রাত ১১ টায় ধর্মতলা থেকে বাস ধরে পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছালাম। যাওয়ার পরই অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হয়নি। যাইহোক, সকাল দশটা নাগাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ডাক্তার দেখে বললো "দেরি করে ফেলেছেন"। সন্ধ্যা'র পরে একটু ভালোর দিকেই যাচ্ছিলো। রাত ন' টা নাগাদ ডাক্তারবাবু বললেন "মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে যাবেন"। রাত বারোটা কুড়ি মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাবা।
বিগত কয়েক বছর ধরেই আত্মীয় স্বজন, কিছু বন্ধুবান্ধব আমাকে বলে "তুই ঠিক তোর বাবা'র মতো হয়েছিস"। কাল থেকেই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে সত্যিই কি আমি কিছুটা হলেও বাবার মতো হতে পেরেছি?
অনেক ভেবে দেখলাম না হতে পারার পাল্লাই বেশি ভারী। যেমন বাবার মতো প্রত্যাশাহীন আমি হতে পারিনি বা শিখিনি। বাবার মতো নম্র (humble) আমি হতে পারিনি। বাবার মতো সব কিছু মেনে নিয়ে, সব কিছু ভুলে গিয়ে হাসিমুখে থাকতে পারা আমি রপ্ত করে উঠতে পারিনি। বাবার মতো পরোপকারীও আমি হতে পারিনি। আর সবচেয়ে বড় যেটা তা হলো আমি বাবার মতো বই, পত্র - পত্রিকা পড়ে উঠতে পারি না। পছন্দ না হওয়ায় বাবা পদস্থ সরকারি চাকরি ছেড়ে দিতে পারার মতো সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। আমার সে সাহস নেই।
আজ আমিও একজন বাবা। গতকাল সন্ধ্যায় আমার পুত্র একটা পুরোনো পারিবারিক ছবি দেখে হঠাৎই জিজ্ঞেস করলো "তোমাকে দাদুর মতো লাগে কেনো?" হয়তো চেহারা বা গড়নের দিক থেকে বাবার সাথে আমার কিছুটা সাদৃশ্য আছে কিন্তু সত্যিই কি আমি কোনোদিন বাবার মতো বাবা হয়ে উঠতে পারবো? জানিনা। সম্ভবতঃ বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যেটা পেয়েছি তা হলো বাবার মতোই আমিও নিজের আবেগ বা উচ্ছ্বাসকে প্রকাশ করতে পারি না। আর কিছুটা বোধহয় কথার দাম, সততা, লোক না-ঠকানো ও সম্পর্কের গভীরতায় বিশ্বাস করা (এখনও অবধি!!) ।
নীচের পারিবারিক ছবিতে আমি তখন ক্লাস ফোর আর দিদি ক্লাস সেভেন।
সুমন সিনহা
০৬/০২/২০২৪




ন্যায় অন্যায়ের দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকা যায় না। পক্ষ বেছে নিতে হয়। পক্ষ বেছে নিয়েও অনেকে নিরপেক্ষ ব'লে দাবি করে বা দেখায় বা কিছুই বোঝে না এমন ভান করে। কিন্তু সেরকম লোকজন সব যুগেই কম বেশী ছিলো। সামাজিক মাধ্যমের যুগে আজকাল হয়তো সেটা একটু বেশিই নগ্ন হয়ে চোখে পড়ে। ভ্রম সকলেরই হয় কিন্তু বিভ্রান্ত না হলেই হলো। মোদ্দা কথা ন্যায় অন্যায়ের দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকা যায় না। পক্ষ বেছে নিতে হয়। আজ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার চারটে লাইন টাইমলাইনে থাক...
"অস্থির হয়ো না,
শুধু প্রস্তুত হও।
এখন কান আর চোখ
খোলা রেখে
অনেক কিছু দেখে যাওয়ার সময়।"
সুমন সিনহা
২২/০১/২০২৪
"আমি সমস্তই দেখিলাম, সমস্ত বুঝিলাম। যে গোপনেই আসিয়াছিল, তাহাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু এই নির্জন নিশীথে সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল, তাহা কিছুই জানিতে পারিল না।"
শ্রীকান্ত
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


12th Fail

যাই হোক, শেষমেশ গত রবিবার "12th ফেইল" দেখলাম। হলে গিয়েই দেখেছি। এর আগে তিনবার অ্যাটেম্পট্ নিয়েও দেখতে যেতে পারিনি। সিনেমাটির শেষের দিকের একটা ডায়লগেই মোটামুটি মূল বক্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
"If I cannot be the sun
that shines upon the earth,
I can still be a lamp
and light up my street"
যাই হোক, আমি রিভিউ লিখতে বসিনি কারণ সে যোগ্যতা আমার নেই। মোটামুটি সবাই জানেন সিনেমাটির বিষয়বস্তু। একটি অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলের (মনোজ) স্বপ্ন পূরণের অদম্য জেদ ও তার সংগ্রামের কাহিনী এবং একই সাথে মনোজের সততা সিনেমাটির প্লট। এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে শেষ অবধি মনোজের স্বপ্ন পূরণ মানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা ক্র্যাক করে IPS অফিসার হওয়া। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা ক্র্যাক করা মানেই শুধু জীবনে সফলতা পাওয়া- তা কখনোই নয়, সিনেমাটিতে UPSC ক্র্যাক করাটা সিমবলিকাল্ (অনুরাগ পাঠকের বইটি অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরী বলেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ব্যাপারটা দেখানো হয়েছে)। তা সে যাই হোক, এইরকম প্লটে আগেও অনেক সিনেমা তৈরী হয়েছে। কিন্তু এই সিনেমাটা এতো হিট কেনো বা এই সিনেমাটা নিয়ে এতো হৈচৈ বা আলোড়ন কেনো। আমার যেটা মনে হয়েছে বা যে কারণে সিনেমাটা খুব ভালো লেগেছে সেটা হলো যে পরিচালক বিধূ বিনোদ চোপড়া শুধু মনোজের সততা দেখান নি, দেখিয়েছেন সম্পর্কের সততা ও জীবনে তার গুরুত্ব, দেখিয়েছেন একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের জন্য আমাদের চারপাশে একটা ভালো সার্কেল থাকা খুব জরুরী। ছোটোবেলা থেকেই আমরা সবাই পড়ে এসেছি "A person is known by the company he/she keeps"। এই প্রবাদপ্রতিম বাক্যটি যে কতটা মূল্যবান ও প্রয়োজনীয়, গোটা সিনেমা জুড়ে তারই প্রতিফলন কিন্তু সেটা দেখাতে গিয়ে কোনো বাহুল্য নেই। সম্পর্কে স্বাভাবিকতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, সততা থাকলেই বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসার জায়গা তৈরী হয়ে যায়, তার জন্য বড়াই করার দরকার পড়ে না - এই সরল সত্যটি পরিচালক খুব নিপুণ ও ক্যান্ডিড ভাবে গোটা সিনেমা জুড়ে প্রত্যেকটা সম্পর্কের মধ্যে তুলে ধরেছেন। যেমন মনোজের সাথে ওর বন্ধু প্রীতমের সম্পর্ক। প্রীতম বা মনোজ কেউই কখনো কাউকে বলে না "আমি সবসময়ই তোর কথা ভাবি বা তুইই আমার সব..." । তাদের অ্যাক্টিভিটিসের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায় একজনের প্রতি অন্যজনের টান বা ভালোবাসা। একে অপরকে দ্বিধাহীনভাবে তার ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে পিছপা হয় না কিন্তু তাতে কখনো তাদের সম্পর্কে চিড় ধরে না। প্রীতম একটা ক্ষমাহীন ভুল করার পরে যখন মনোজ সন্দেহের বশে প্রীতমের মোবাইল দেখতে চায়, প্রীতম কোনোরকম আটকায় না বা কোনো অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করে না। ধরা পড়ে যাবে জেনেও প্রীতম অবলীলায় মনোজকে মোবাইলটা দেখতে দিয়ে দেয়। ছোটো একটা ঘটনা কিন্তু সম্পর্কের বা বন্ধুত্বের গভীরতা ফুটে ওঠে প্রবল ভাবে। বা মনোজের কোচিং সেন্টারের দাদা গৌরী ভাইয়ার কথা ধরা যাক। হেরে যাওয়া মানে যে হারিয়ে যাওয়া নয় তা গৌরি ভাইয়াকে দেখে শিখতে হয়। মনোজ ও গৌরি ভাইয়ার একে অপরের প্রতি যে নিঃশর্ত ও নিস্বার্থ ভালোবাসা, সেটা সম্পর্কে সততা না থাকলে দেখানো যায় না। এর পরে মনোজ আর শ্রদ্ধা'র সম্পর্ক। শ্রদ্ধা মনোজের যতোটাই বান্ধবী, ঠিক ততটাই প্রেমিকা। একদম বাহুল্যবর্জিত, শো-অফহীন একটা খাঁটি প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক, একটা অবলম্বনের জায়গা, একটা ভরসার স্থান, পাশে থাকার অঙ্গীকার। কোনো ফাঁকা আওয়াজ নেই, কোনো ফাঁপা প্রতিশ্রুতি নেই, কথার ফুলজুড়ি নেই, উপহারের আড়ম্বর নেই অথচ অধিকারবোধ আছে, নীরবতার ভাষা আছে। শ্রদ্ধা'র মনোজকে বই উপহার দেওয়া, সময় দেওয়া, মনোজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া - এ সবের মধ্যে একটা আটপৌরে ব্যাপার আছে, কোনো কৃত্রিমতার গন্ধ নেই।
আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি। কেউই কখনো কোনো অবস্থায় আত্মসম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করেনি। মনোজ, মনোজের বাবা, মা, দাদা ও ঠাকুমা, প্রীতম, গৌরি ভাইয়া, শ্রদ্ধা, পুলিশ অফিসার দুস্মন্ত সিং প্রত্যেকেই নিজেদের জীবনের কঠিন সময়েও নিজেদের মূল্যবোধ বা নীতিবোধ বা সম্মানবোধ থেকে একচুলও সরে আসেনি। যখন যেখানে যতটা দৃঢ়তা দেখানোর প্রয়োজন, প্রত্যেকেই সেই দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। পরিচালক খুব সচেতনভাবে এই জিনিসগুলোকে প্রেজেন্ট করেছেন বলে মনে হয়েছে আমার।
সম্ভবত এই সমস্তকিছুর জন্যই মানুষ সিনেমাটির সাথে কানেক্ট করতে পেরেছে।

সুমন সিনহা
১০/০১/২০২৪


ঋত্বিক ঘটক

"তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে"
আজ স্পর্ধার জন্মদিন
আজ ঋত্বিক ঘটকের জন্মদিন।
ভাবতেও অবাক লাগে যে এই 'ইতরের দেশে' যেখানে 'বণিকেরা লেখকদের উদ্ভাবন করে', 'যেখানে অবশ অক্ষরমালা চিবোতে চিবোতে কবিরা গরু হয়ে যায়' সেখানে অকৃত্রিম ঋত্বিক ঘটক একদিন ছিলেন। ক্ষমা করবেন ঋত্বিক বাবু - বাঙালি ঋত্বিক হয়ে উঠতে পারেনি, যে বাঙালিকে ধাক্কা দিয়ে আপনি সোচ্চারে বলেছিলেন "আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি" বা "অ্যাপোলিটিকাল বলে কোনো কথা হয় না"। সেই সময়টা হয়তো আপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, আপনার প্রতিভাকে অস্বীকার করেছিলো কিন্তু "পিপল'স আর্টিস্ট" আপনিই।
সুমন সিনহা
০৪ / ১১ /২০২৪


Home for aged blind women

Today we had spent some time in an old age home of needy blind Grannies. It is run under Poona Blind Men's Association (PBMA) which works extensively with the blind population of India. The name of this particular home is "Shirdi Sai Baba Home for Aged Blind Women of PBMA" that gives shelter to the shelterless and destitute blind old ladies. It is located at Nanded Phata, Village - Dhayri on Sinhagad road, Pune. We are amazed by the infrastructure and the facilities available there. The home now accommodates 43 blind ladies aged between 45 to 91. Not only they are provided with a decent shelter but also they have all facilities for a happy living and that too, at absolutely free of cost. Morning tea /coffee, breakfast, lunch, dinner, milk before sleep - all are served timely. The Grannies also get themselves involved in useful and productive activities like knitting, stitching, other handicrafts, bhajans, storytelling, reading Braille books, evening common 'Arati'. They also enjoy music and T. V programmes. Most of the times, radio is a good companion of many of them. Regular visit by doctor(s) takes care of their health issues with a resident clinical assistant. Hospitalizations, when required, are referred to various city hospitals and the expenses are borne by the Organization. It was really a pleasure to have detailed discussions with Mrs. Sonal Bramhanwade Patre madam and Dr. S. Kulkarni on various topics and issues related to social services in our country.
Suman Sinha
02/10/2023



ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

আমাদেরও একজন বিদ্যাসাগর ছিলেন। ভাবতেই কেমন অবাক লাগে আজ। একজন শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারকই শুধু ছিলেন না উনি, সীমাহীন ব্যাপ্তি ছিল ওঁর। বাংলা গদ্যের আধুনিকীকরণ ও বাংলা বর্ণমালার বিজ্ঞানসম্মত রূপায়ণে ওঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নে শুধু মুখ্য ভূমিকাই উনি নেন নি, বিধান পরিষদে সেই আইন পাশ করাবার জন্য চরম বিরোধিতা ও অপমান সহ্য করেও সই সংগ্রহে নেমেছিলেন। বিরোধীরাই বেশি সই সংগ্রহ করেছিলেন। বিল পাশের বিরুদ্ধে প্রায় চারগুণ বেশি সই পড়েছিল!! না, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (majoritarianism) মানেই ঠিক নয়। লর্ড ডালহৌসী বিলটি চূড়ান্ত করেন ও ১৮৫৬ সালে বিধানসভায় বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। বাল্যবিবাহ'র বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল ছিল Age of Consent Act, 1891. নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে গলা ফাটানো এই অগ্রণী বাঙালি পুরুষ মানুষটিকে আজকের দিনে স্মরণ করা ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি!

সুমন সিনহা

২৬/০৯/২০২৩ 



এলোমেলো ভাবনা - ৮

২৭ বছর আগেকার একটা পুরোনো বিল (মহিলা সংরক্ষণ বিল) সংসদের নিম্নকক্ষে পাশ হওয়াতে খুব হইচই দেখছি। নানা মুনির নানা মত আর কি। মূলতঃ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী'র উদ্যোগ ছিলো এই বিলটির প্রনয়ণে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার সিপিআই সাংসদ গীতা মুখার্জি তিনদশক আগে প্রাইভেট মেম্বার বিল হিসেবে এটি সংসদে প্রথম পেশ করেন। কেনো তিন দশক ধরে বিলটি পড়ে ছিল এবং এখনই বিলটি পাশ করাবার প্রয়োজন পড়লো, সেটা নিয়ে উল্লাসকারীদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা বা লজ্জা কোনোটাই নেই। এটা খুব পরিষ্কার যে রাজনৈতিক এজেন্ডাই এই বিল পাশের মূল কারণ এইসময়।

যাইহোক, এই বিল নানা জন নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন। কেউ বলছেন এই বিল কি মহিলাদের পক্ষে সম্মানের? মহিলারা যদি পুরুষদের সমানই হন, তাহলে আলাদা করে সংরক্ষণ কেনো? কেউ বলছেন মিমি, নুসরৎদের মত মহিলাদের সংসদে আসা আরো সহজ হয়ে গেলো! কেউ বলছেন মহিলারা কি সত্যি নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে)? এ প্রসঙ্গে অনেকেই দেখলাম গ্রাম পঞ্চায়েত গুলোর উদাহরণ দিচ্ছেন। অনেক মহিলাই পঞ্চায়েত প্রধান বা পঞ্চায়েতের অন্যান্য পদে আছেন। কিন্তু তারা সই ছাড়া আর কিছুই করেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই তাদের বর বা ভাসুর বা জামাইবাবু বা শ্বশুরমশায়কে জিজ্ঞেস করতে বলেন। ইনফ্যাক্ট, অনেকেই অফিসেও যান না। তাদের জায়গায় ওইসব পুরুষরাই বেশিরভাগ সময় বসে থাকেন। অর্থাৎ খাতায় কলমে নারীর ক্ষমতায়ণ দেখালেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেইসব নারীদের কোনো ক্ষমতাই নেই। কিন্তু শুধুমাত্র গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোতেই এরকম হয়, তা একেবারেই নয়। একটু যদি চোখ কান খোলা রাখা যায়, তাহলে দেখবেন পয়সাওয়ালা লোকজনদের "অভিজাত" ক্লাব/সংস্থা গোছের জায়গাগুলোতেও 'মহিলা পরিচালিত' , 'women powered' ইত্যাদি অনেক রকম বড় বড় কথা লেখা থাকলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় মহিলাদের কোনো ভূমিকাই নেই। সেসব মহিলারা কিন্তু বেশ "শিক্ষিত"। অনেকেই আবার তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন। ইনফ্যাক্ট, বেশিরভাগ মহিলাই কিন্তু গর্ববোধ করেন পদের জন্য বা সেসব ক্লাব/সংস্থার সাথে যুক্ত হতে পেরে। তাদের বরেরা বা অন্য পুরুষরা সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন - এতে তারা বরং খুশিই হয়। কখনো তাদের আত্মসম্মানে লাগে না। অনেকে তো প্রকাশ্যে বলেন যে অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার থাকে, আমরা মেয়েরা কি অতসব সামলাতে পারি।!!!! বরং সমাজের "নিচু স্তরে" কাজের দিদি বা সব্জি/ফল বিক্রেতা বা দোকান চালিকারা অনেক বেশী নিজেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, কাউকে তোয়াক্কা বা শো-অফ না ক'রে।

সুমন সিনহা
২১/০৯/২০২৩

দিনগুলি মোর - ১

এখানকার বর্ষার চরিত্র পশ্চিমবঙ্গের বর্ষার চরিত্র থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রায় আড়াই তিন মাস ধরে বৃষ্টি পড়তেই থাকে - কখনো এক নাগাড়ে, কখনো থেমে থেমে - কখনো খুব জোরে আবার কখনো মাঝারি মাপের। রোদের দেখা প্রায় মেলেনা বললেই চলে। মাঝে মধ্যে একটু হাল্কা রোদ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। স্থায়িত্ব খুব কম। তার মধ্যে দিনে রাতে বৃষ্টি চলতেই থাকে। তবে পাওয়ার কাট বা লোডশেডিং খুব কমই হয়। হ'লেও তাড়াতাড়িই চলে আসে। তবে ব্যতিক্রম যে মাঝে মধ্যে হয় না তা নয়।

এই কিছুদিন আগে একদিন সারাদিন ধরেই বৃষ্টি পড়ছে। ভরা বর্ষা যাকে বলে আর কি। সন্ধ্যের পর থেকে বৃষ্টির তীব্রতা আরো বাড়লো এবং ঝুপ করে লোডশেডিং। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন কারেন্ট এলো না, বুঝলাম ভোগাবে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম - চারিদিকে নিকষ অন্ধকার আর অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বৃষ্টির শব্দের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে - অনুভূতি তে ধরা দেয়। বহুবছর পর সন্ধ্যারাতে একই সাথে লোডশেডিং এবং বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি আমাকে নিয়ে চলে গেলো সুদূর অতীতের সেইসব সন্ধ্যায় যখন বর্ষাকালে সন্ধ্যায় ঝমঝম বৃষ্টির সাথে লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ঘটনা এবং খুবই সাধারণ ব্যাপার।
তা আজ থেকে প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ আগের সেসব দিনের কথা আজও স্মৃতিতে পুরোপুরি ধূসর হয়ে যায় নি। মফস্বল শহরের পৈতৃক বাড়ি অনেকটা জায়গা জুড়ে হলেও বেশীরভাগটাই উন্মুক্ত জায়গা ছিল। আমাদের একটা বড় ঘর ছিল, আর তার সাথে লাগোয়া একটা ছোটো ঘর। সেই ছোটোঘরটাই তখন রান্নাঘর ছিল। পরে অবশ্য বাবা আলাদা একটা রান্নাঘর বানিয়েছিল। বড় আর ছোট ঘরের সামনেটা জুড়ে বেশ বড় একটা লাল রঙের শানবাঁধানো বারান্দা। বারান্দা থেকে সিড়ি দিয়ে নামলে ইঁটবাঁধানো বিশাল বড় আয়তাকার একটা উঠোন। উঠোনের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় আর একটি বড় ঘর, একটি ছোটো ঘর ও দুটো ঘরের সাথেই লাগোয়া একফালি একটা খালি জায়গা ছিল। উঠোনের ঠিক পূর্বে একটি কুয়ো ছিল। ঐ কুয়ো থেকেই জল তোলা হতো তখন। ঐ লাল শানবাঁধানো বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছিল না। পরে অবশ্য গ্রিল বসানো হয়। বারান্দায় একটা কাঠের চৌকি রাখা থাকতো আর চৌকির পাশে বেশ উঁচু একটা টেবিল থাকতো। যখন বৃষ্টি পড়তো তখন আমি আর দিদি চৌকির ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে বৃষ্টি দেখতাম। এলোমেলো হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে যখন গায়ে লাগত, তখন কি যে একটা রোমাঞ্চ হতো আমার! একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উঠোনে জল জমে যেতো। কাগজের নৌকা বানিয়ে বারান্দার সিড়িতে বসে উঠোনের জমা জলে নৌকো ভাসানোয় এক অনাবিল আনন্দ ও চরম উত্তেজনা ছিল। বৃষ্টি থামলেই উঠোনের জমা জলে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চারিদিকে জল ছেটানো ছিল বর্ষার দিনে আমাদের প্রধান খেলা।
এরকম বৃষ্টির দিনে সাধারণতঃ কারেন্ট থাকতো না, বিশেষত সন্ধ্যার পর থেকেই। বৃষ্টির দিনগুলোতে লেখাপড়া করতে মন লাগতো না কিন্তু সন্ধ্যা হ'লেই পড়তে বসা ছিল বাধ্যতামূলক। মাটিতে শতরঞ্জি পেতে একটা হারিকেনের এক দিকে আমি আর অন্য দিকে দিদি। চারপাশে বইখাতা। দুটো হারিকেন ছিল। একটা হারিকেন নিয়ে মা ছোটো ঘরটাতে রান্নাবান্না, সংসারের কাজ এসব করতো আর অন্য হারিকেন টা নিয়ে বড় ঘরের মেঝে তে আমি আর দিদি। বাইরে বৃষ্টি, অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হারিকেনের আলো ঘরের রংচটা দেয়ালের ওপর কেমন একটা আলো আঁধারি সৃষ্টি করতো। মাঝে মাঝে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বাইরের বৃষ্টি দেখতাম। অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টির শব্দটাই শুধু শুনতে পেতাম। এখনও বৃষ্টির শব্দ আমায় টানে।
হারিকেনের আলো কার দিকে বেশি পড়ছে সেই নিয়ে আমার আর দিদির ঝগড়া লেগেই থাকতো। কিছু সময় পর পর দুজনেই চেঁচিয়ে মা কে নালিশ জানাতাম "মা, ও নিজের দিকে হারিকেনটা বেশি ঘুরিয়ে নিচ্ছে"। বেশ কয়েকবার বকাবকি বা বারণ করার পরও মা যখন দেখতো কাজ হচ্ছে না, তখন মার দেওয়ার পালা। দিদি মেয়ে বলে বেশীরভাগ সময়ই বেঁচে যেতো, মারটা আমার কপালেই জুটতো। তারপর কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। আর তার কিছুক্ষণ পর দিদি বলতো "এ নে ভাই, তোর দিকেই হারিকেন টা বেশি ঘুরিয়ে দিলাম"। এমন একটা পারিবারিক বন্ধনে বড় হয়েছিলাম যে দিদির ওই কথায় রাগের বদলে আমার আনন্দই হতো। আসলে ভালোবাসা সহজাত, ওটা শেখাতে হয় না। ঘৃণার ঠিক উল্টো! হারিকেন জ্বালালে একটা হাল্কা কেরোসিন তেলের গন্ধ পাওয়া যেতো। সেই চেনা গন্ধ আজ একদমই অচেনা হয়ে গেছে।
অন্ধকারের একটা সীমানা আছে। হারিকেনের আলোয় পড়বার সময়ে বোধহয় অজান্তেই মনের ভেতর সেই সীমানা পেরোনোর একটা ইচ্ছে গেঁথে গিয়েছিলো। হারিকেনের পাঠ তো কবেই চুকেছে। আজ চারিদিকে বড্ড আলো। কারেন্ট চলে গেলেই লেড্ আলোর এর্মাজেন্সী, টর্চ। তার ওপর একাধিক মোবাইল ফোনের টর্চের আলোর তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। স্পষ্ট দেখবার বদলে কেমন যেনো ঝাপসা দেখি সবকিছু। সেই ঝাপসা চোখে নিজের ঘরে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে শুধু মনে হয় - "কি জানি কিসের লাগি, প্রাণ করে হায় হায়"। সুসভ্যতার আলোর বদলে যদি কেউ সেই অন্ধকারটা আবার ফিরিয়ে দিতে পারতো!

সুমন সিনহা
পুণে, ১০/০৯/২০২২

পুনশ্চ: নিচের ছবিটি আমাদের বড় ঘরে তোলা। যতদূর মনে পড়ে আমি তখন ক্লাস ফাইভ আর দিদি তখন ক্লাস এইট।


এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...