Monday, April 8, 2024

হাটে বাজারে - ১

দেখতে দেখতে প্রায় দশ বছর কেটে গেলো পুণেতে। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যে বাইরে কোথাও কর্মসূত্রে আসতে হবে বা থাকতে হবে, কোনোদিনও ভাবিনি। তবুও আসতে হয়েছিলো। বাধ্যবাধকতা আর কি। এখনও প্রায়ই মনে হয় - না এলেই বোধহয় ভালো ছিলো। এই শহরটার সাথে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারিনি, যোগাযোগটাই তৈরী হয়নি আসলে। তবুও রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে, দোকান-বাজার করতে গিয়ে কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ তৈরী হয়ে যায়। তাদের সাথে ফোনে কথা হয় না বা চ্যাট হয় না বা অনেক সময়ই নিয়মিত দেখাও হয় না। তবুও একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। এই যেমন ধরুন উত্তম বাবুর কথা। ওর একটা ফুচকার দোকান আছে। হ্যাঁ, অবশ্যই বাঙালি ফুচকা। নান্দেরফাটা থেকে কিছুটা ভিতরে ওর দোকান। পাকা কোনো দোকান নয়, রাস্তার ওপরেই এক ফালি জায়গায় ছোট্ট একটা স্টল মতো আর কি। এই বছর খানেক আগে আমি ওর ফুচকার দোকানের কথা জানতে পারি, তার আগে জানতামও না। জানার পর থেকে প্রায় নিয়মিত আমি ফুচকা খেতে যাই। বহরমপুর বা কলকাতায় থাকতে আমি যে খুব একটা ফুচকা খেতাম, তাও নয়। কিন্তু এখানে এই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে এসে বাঙালি কোনো দোকান দেখলেই কেমন একটা টান অনুভব করি, মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে যেনো কোনোভাবে কানেক্ট করতে পারছি। তাই প্রায়ই অফিস শেষ হওয়ার পর বা কোনো ছুটির দিনে সন্ধ্যা বেলায় চলে যাই উত্তম বাবুর কাছে। কিছুক্ষণ গল্প করি ওর সাথে, ফুচকা খাই তারপর চলে আসি। উত্তম বাবুর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়। মেচেদা, কোলাঘাট এলাকাতেও ওর অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে। পারিবারিক হোটেল ব্যবসা আছে ওদের। মূলত হলদিয়া ডক এলাকেতে ওদের ছোটখাটো হোটেল আছে। প্রায় বাইশ বছর হলো উনি পুণেতে এসেছেন। প্রথমে একটা ফ্রেবিকেশন কোম্পানিতে কাজ করতেন। বছর আষ্টেক হল সেই কোম্পানিটি পুণে ছেড়ে চলে যায়। তারপর থেকে উত্তম বাবু এই ফুচকার দোকানটি করেন। কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের নানা গল্প উনি করেন, ওখানকার বর্তমান রাজনীতি নিয়েও বলেন। কতো অকপটে, কোনো ভনিতা না করেই সব কিছু বলেন। মুখে সব সময় একটা স্মিত হাসি লেগেই থাকে। কোনো মেকি ব্যাপার থাকে না। কিছুদিন না যেতে পারার পর যখন যাই, তখন এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করেন আমায় "কেমন আছেন? অনেকদিন আসেন নি, ভাবছিলাম কি হলো।" জিজ্ঞেস করার মধ্যে একটা আন্তরিকতা থাকে। বউ, ছেলের খবরও নেন। উত্তম বাবুর তিন মেয়ে। বড় মেয়েটা দেশের বাড়িতেই থাকে। মেজো ও ছোটটি পুণেতেই থাকে। মেজো মেয়েটা পুণেতেই একটা কলেজে স্নাতক পড়ছে এখন। ছোটটা স্কুলে। উত্তম বাবুর বউ বাড়িতেই ফুচকা ভাজেন। তাই ফুচকা গুলোর স্বাদ একদম পশ্চিমবাংলার মতো, এখানকার মতো নয়। উত্তম বাবু তেঁতুল জল বা আলুমাখা দারুণ মুখরোচক ভাবে তৈরী করেন। মশলাগুলো দেশ থেকে আনান। ইচ্ছে করলেই এখান থেকে কিনতে পারেন কিন্তু তবুও উনি দেশ থেকে আনান। একেই বোধহয় নাড়ির টান বলে, ভালোবাসা বলে। কলকাতায় দুটো জায়গায় ফুচকা খুব বিখ্যাত ছিল একসময় - একটা লেকটাউনের মোড়ে আর একটা শ্রীরাম আর্কেডের সামনে বসতো। এখন জানিনা অবশ্য। উত্তম বাবুর ফুচকার মধ্যে সেরকমই স্বাদ পাই অনেকটা। আমি গেলে আমাকে অন্যদের থেকে একটু বেশিই খাতির করেন দেখি, মানে আলুটা আলাদা করে মাখে ছোলা বেশি দিয়ে, লেবুর পরিমাণ ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞেস করেন, সবসময় দুএকটা বেশি ফুচকা দেন। পুত্রকে নিয়ে গেলে তো কথাই নেই, বেশ কিছু অতিরিক্ত ফুচকা জুটে যায় ওর। কিন্তু পয়সা বেশি দিতে চাইলেও কিছুতেই নেন না। মাঝে মাঝে বিড়ম্বনা বোধ করি একটু। আবার বারবার পয়সা বেশি নেওয়ার কথা বললে ওকে ছোট করা হয়। তাই আর বলি না। একটা অকৃত্রিমতা আছে সম্পর্কটার মধ্যে। এই অকৃত্রিমতা, এই স্বতঃস্ফূর্ততা বড়ো ভালো লাগে আমার। ফুচকা খেতে গেলেই মাঝে মাঝেই আমাকে উনি বলেন "আপনার মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে একটা ফোন করুন তো"। রিং হলেই আমি ওকে ফোনটা দিয়ে দিই। উনি ওর স্ত্রীকে আরো ফুচকা দিয়ে যেতে বলেন। আমি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম "এটা তো তোমার মোবাইল। তোমার কাছে কখনো থাকে না কেনো? (আমি ওকে তুমি বলেই ডাকি, উনিই বলেছিলেন 'তুমি' করে সম্বোধন করতে)। উত্তম বাবু বললেন "এর আগে দোকান থেকে দুটো মোবাইল চুরি গেছে। মোবাইল টা দোকানে রেখে কাজ করতাম। সবসময় পকেটে রাখা যায় না। কোনো ফোন এলে পকেট থেকে বের করা অসুবিধে। খরিদ্দারদের ফুচকা দিচ্ছি, আলু মাখছি, কোনো না কোনো কাজে সবসময়ই ব্যস্ত থাকি, তাই সবসময় মোবাইল ফোনের দিকে নজর দেওয়া যায় না। কখন যে কে এসে মোবাইলটা তুলে নিয়ে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। তাই আর দোকানে মোবাইল আনি না।" শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। উত্তম বাবুর দোকান বন্ধ করে সব গুছিয়ে বাড়ি যেতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যায়। দোকান খোলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। দীর্ঘ সময় মোবাইলের সাথে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই দিব্যি চলে যায় উত্তম বাবুর। আমি হলে কি পারতাম সেটা? উত্তম বাবুদের মতো মানুষ দেখলে এখনও একটা ভরসা হয়। ছদ্ম, মেকি, বড়াই করা, ফাঁপা, বিশ্বাসহীন ভোগবাদী সম্পর্কের বর্তমান জগতে যখন প্রতিনিয়ত হাঁপিয়ে উঠি, তখন উত্তম বাবুর মতো কারোর কাছে গিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারি - এমন প্রিভিলেজই বা কতজন পায়? জীবন তো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একজন বা কয়েকজনের সাথে "সম্পর্ক" রেখে যাওয়ার একপেশে চেষ্টা নয়!!!
নীচের ছবিটি উত্তম বাবুর সাথে। উত্তম বাবুর অনুমতি নিয়েই ছবিটি পোস্ট করেছি।
সুমন সিনহা
২৬/০৩/২০২৪


No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...