Monday, April 8, 2024

দিনগুলি মোর - ১

এখানকার বর্ষার চরিত্র পশ্চিমবঙ্গের বর্ষার চরিত্র থেকে অনেকটাই আলাদা। প্রায় আড়াই তিন মাস ধরে বৃষ্টি পড়তেই থাকে - কখনো এক নাগাড়ে, কখনো থেমে থেমে - কখনো খুব জোরে আবার কখনো মাঝারি মাপের। রোদের দেখা প্রায় মেলেনা বললেই চলে। মাঝে মধ্যে একটু হাল্কা রোদ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। স্থায়িত্ব খুব কম। তার মধ্যে দিনে রাতে বৃষ্টি চলতেই থাকে। তবে পাওয়ার কাট বা লোডশেডিং খুব কমই হয়। হ'লেও তাড়াতাড়িই চলে আসে। তবে ব্যতিক্রম যে মাঝে মধ্যে হয় না তা নয়।

এই কিছুদিন আগে একদিন সারাদিন ধরেই বৃষ্টি পড়ছে। ভরা বর্ষা যাকে বলে আর কি। সন্ধ্যের পর থেকে বৃষ্টির তীব্রতা আরো বাড়লো এবং ঝুপ করে লোডশেডিং। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন কারেন্ট এলো না, বুঝলাম ভোগাবে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম - চারিদিকে নিকষ অন্ধকার আর অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বৃষ্টির শব্দের একটা নিজস্ব ছন্দ আছে - অনুভূতি তে ধরা দেয়। বহুবছর পর সন্ধ্যারাতে একই সাথে লোডশেডিং এবং বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি আমাকে নিয়ে চলে গেলো সুদূর অতীতের সেইসব সন্ধ্যায় যখন বর্ষাকালে সন্ধ্যায় ঝমঝম বৃষ্টির সাথে লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ঘটনা এবং খুবই সাধারণ ব্যাপার।
তা আজ থেকে প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ আগের সেসব দিনের কথা আজও স্মৃতিতে পুরোপুরি ধূসর হয়ে যায় নি। মফস্বল শহরের পৈতৃক বাড়ি অনেকটা জায়গা জুড়ে হলেও বেশীরভাগটাই উন্মুক্ত জায়গা ছিল। আমাদের একটা বড় ঘর ছিল, আর তার সাথে লাগোয়া একটা ছোটো ঘর। সেই ছোটোঘরটাই তখন রান্নাঘর ছিল। পরে অবশ্য বাবা আলাদা একটা রান্নাঘর বানিয়েছিল। বড় আর ছোট ঘরের সামনেটা জুড়ে বেশ বড় একটা লাল রঙের শানবাঁধানো বারান্দা। বারান্দা থেকে সিড়ি দিয়ে নামলে ইঁটবাঁধানো বিশাল বড় আয়তাকার একটা উঠোন। উঠোনের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় আর একটি বড় ঘর, একটি ছোটো ঘর ও দুটো ঘরের সাথেই লাগোয়া একফালি একটা খালি জায়গা ছিল। উঠোনের ঠিক পূর্বে একটি কুয়ো ছিল। ঐ কুয়ো থেকেই জল তোলা হতো তখন। ঐ লাল শানবাঁধানো বারান্দাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছিল না। পরে অবশ্য গ্রিল বসানো হয়। বারান্দায় একটা কাঠের চৌকি রাখা থাকতো আর চৌকির পাশে বেশ উঁচু একটা টেবিল থাকতো। যখন বৃষ্টি পড়তো তখন আমি আর দিদি চৌকির ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে বৃষ্টি দেখতাম। এলোমেলো হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে যখন গায়ে লাগত, তখন কি যে একটা রোমাঞ্চ হতো আমার! একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উঠোনে জল জমে যেতো। কাগজের নৌকা বানিয়ে বারান্দার সিড়িতে বসে উঠোনের জমা জলে নৌকো ভাসানোয় এক অনাবিল আনন্দ ও চরম উত্তেজনা ছিল। বৃষ্টি থামলেই উঠোনের জমা জলে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চারিদিকে জল ছেটানো ছিল বর্ষার দিনে আমাদের প্রধান খেলা।
এরকম বৃষ্টির দিনে সাধারণতঃ কারেন্ট থাকতো না, বিশেষত সন্ধ্যার পর থেকেই। বৃষ্টির দিনগুলোতে লেখাপড়া করতে মন লাগতো না কিন্তু সন্ধ্যা হ'লেই পড়তে বসা ছিল বাধ্যতামূলক। মাটিতে শতরঞ্জি পেতে একটা হারিকেনের এক দিকে আমি আর অন্য দিকে দিদি। চারপাশে বইখাতা। দুটো হারিকেন ছিল। একটা হারিকেন নিয়ে মা ছোটো ঘরটাতে রান্নাবান্না, সংসারের কাজ এসব করতো আর অন্য হারিকেন টা নিয়ে বড় ঘরের মেঝে তে আমি আর দিদি। বাইরে বৃষ্টি, অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। হারিকেনের আলো ঘরের রংচটা দেয়ালের ওপর কেমন একটা আলো আঁধারি সৃষ্টি করতো। মাঝে মাঝে ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বাইরের বৃষ্টি দেখতাম। অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টির শব্দটাই শুধু শুনতে পেতাম। এখনও বৃষ্টির শব্দ আমায় টানে।
হারিকেনের আলো কার দিকে বেশি পড়ছে সেই নিয়ে আমার আর দিদির ঝগড়া লেগেই থাকতো। কিছু সময় পর পর দুজনেই চেঁচিয়ে মা কে নালিশ জানাতাম "মা, ও নিজের দিকে হারিকেনটা বেশি ঘুরিয়ে নিচ্ছে"। বেশ কয়েকবার বকাবকি বা বারণ করার পরও মা যখন দেখতো কাজ হচ্ছে না, তখন মার দেওয়ার পালা। দিদি মেয়ে বলে বেশীরভাগ সময়ই বেঁচে যেতো, মারটা আমার কপালেই জুটতো। তারপর কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। আর তার কিছুক্ষণ পর দিদি বলতো "এ নে ভাই, তোর দিকেই হারিকেন টা বেশি ঘুরিয়ে দিলাম"। এমন একটা পারিবারিক বন্ধনে বড় হয়েছিলাম যে দিদির ওই কথায় রাগের বদলে আমার আনন্দই হতো। আসলে ভালোবাসা সহজাত, ওটা শেখাতে হয় না। ঘৃণার ঠিক উল্টো! হারিকেন জ্বালালে একটা হাল্কা কেরোসিন তেলের গন্ধ পাওয়া যেতো। সেই চেনা গন্ধ আজ একদমই অচেনা হয়ে গেছে।
অন্ধকারের একটা সীমানা আছে। হারিকেনের আলোয় পড়বার সময়ে বোধহয় অজান্তেই মনের ভেতর সেই সীমানা পেরোনোর একটা ইচ্ছে গেঁথে গিয়েছিলো। হারিকেনের পাঠ তো কবেই চুকেছে। আজ চারিদিকে বড্ড আলো। কারেন্ট চলে গেলেই লেড্ আলোর এর্মাজেন্সী, টর্চ। তার ওপর একাধিক মোবাইল ফোনের টর্চের আলোর তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। স্পষ্ট দেখবার বদলে কেমন যেনো ঝাপসা দেখি সবকিছু। সেই ঝাপসা চোখে নিজের ঘরে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে শুধু মনে হয় - "কি জানি কিসের লাগি, প্রাণ করে হায় হায়"। সুসভ্যতার আলোর বদলে যদি কেউ সেই অন্ধকারটা আবার ফিরিয়ে দিতে পারতো!

সুমন সিনহা
পুণে, ১০/০৯/২০২২

পুনশ্চ: নিচের ছবিটি আমাদের বড় ঘরে তোলা। যতদূর মনে পড়ে আমি তখন ক্লাস ফাইভ আর দিদি তখন ক্লাস এইট।


No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...