Monday, April 8, 2024

বৃত্তের বাইরে

দোলা কখন কোথায় যায়, কি করে, কিছুই আর উজান জানতে পারে না এখন।
উজান নিজের ঘরে শুয়ে একটা প্লেলিস্ট চালিয়ে গান শুনছে। সেই মুহূর্তে উজানের প্রিয় একটা গান চলছে... 'আমি তো ছিলাম বেশ নিজের জগতে / আনাগোনা ছিলো শুধু চেনাজানা পথে / খেলার সাথীর হাতে হাত রেখে খেলা / খেলতে খেলতে কেটে গেলো ছেলেবেলা / এখন হঠাৎ কেনো আনমনে ভাবি / এসেছে অবাক করা জীবনের দাবি।'
উজান অবাক হয়ে ভাবছে যে কখনো কখনো জীবন সত্যিই খুব অবাক করা দাবি নিয়ে হাজির হয়।
আমাদের চারপাশে ঘটে চলা কত ঘটনাই আমরা জানতে পারি না। কিছু ঘটনাপ্রবাহ একদম অপ্রত্যাশিত যার জন্য কোনোরকম প্রস্তুতি থাকে না। কিন্তু সেসব ঘটনার অভিঘাত কাউকে কাউকে জীবনের মূল্য দিয়ে চোকাতে হয়। গড়পড়তা চোখে আপাত-নিরীহ সেসব ঘটনাপ্রবাহে অতি সাধারণ, বাজারদরহীন উজানের অনুভূতিগুলোই অবশ হয়ে গেছে। ঘটনাগুলি বহুমাত্রিক যার একদিকে আছে পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে নীতিবোধশূন্য, টাকাপয়সার বৈভব দেখানো কিছু মানুষের ব্যবসায়িক ধান্দাবাজি, অনৈতিক সুবিধেভোগ, ফুর্তি ও বেলেল্লাপনা আর অন্যদিকে আছে দোলার চূড়ান্ত ভন্ডামি, নিপুণ অভিনয় ক্ষমতা, অসম্ভব চালাকি, নিজেকে মহৎ ও নির্দোষ প্রমাণ করার প্রাণপণ হাস্যকর প্রয়াস এবং যেকোনো কিছুর বিনিময়ে কিছু ব্যক্তিবিশেষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও লোভ।
সাধারণতঃ সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আমাদের প্রত্যেকেরই একটা পরিচিতির বৃত্ত থাকে। এই সামাজিক অবস্থান মূলতঃ নির্ধারিত হয় অর্থনৈতিক অবস্থা ও সাংস্কৃতিক বিচরণের ক্ষেত্র দিয়ে এবং কিছুটা রাজনৈতিক বোধও থাকে। অর্থাৎ একটা মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে পরিচিতির বৃত্ত তৈরী হয়। যেমন, বিত্ত দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে মাপা যায় না, মধ্যবিত্ত মূলতঃ একটি মানসিকতা যার সুবাদে আমরা সবাই সেই চেনা বৃত্তের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করি। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন যারা সেই পুরোনো বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতার নতুন একটি বৃত্তে খুব অনায়াসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং সেই বৃত্তের মধ্যে ঢুকে গর্ব ও অহংকার বোধ করেন। কিসের অমোঘ নেশায় মানুষ জেনেবুঝে, সচেতনভাবে, খুবই দ্রুত, কোনোরকম আক্ষেপ বা অনুশোচনা ছাড়া সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানের বৃত্তে অনায়াসে বিচরণ ক'রে বেলাগাম জীবন ও যাপনে স্বেচ্ছায় অভ্যস্ত হয়ে গর্ব বোধ করেন, অন্যদের কাছে জাহির করেন এবং ফিরে আসবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে স্বেচ্ছায় আরো বেশি নিজেদের সেই বৃত্তের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তা উজানের মতো মধ্যমেধার লোক বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু যেটা বুঝতে পেরেছিল, সেটা হলো পুরোনো বৃত্তে বিচরণ তাদের মুখোশ, নতুন বৃত্তে বিচরণের নেশা তাদের মুখ।
ইংরেজিতে 'হার্ড মেন্টালিটি' ব'লে একটি শব্দবন্ধ আছে যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'দলে ভিড়ে যাওয়ার মানসিকতা বা প্রবণতা'। উজানের মধ্যে সেটি একেবারেই ছিলো না। আরো অনেক দোষ উজানের। যেমন তথাকথিত "ক্লাস", "স্ট্যাটাস", "ডিগ্রি" ইত্যাদিকে একেবারেই সে পাত্তা দেয় না। সে বিস্কুটকে কিছুতেই বিস্কিট বা কুকিজ বলতে পারে না!! মদ্যপানকে ড্রিংক্স নেওয়া বলতে পারে না। মানে বলে না আর কি। পয়সার দেমাক ও বৈভব দেখানো লোকজনদের, যারা অনেকের চোখেই "হাই সোসাইটি", তাদের থেকে উজান সচেতন ভাবে দূরত্ব রেখে চলে এবং যেকোনো কিছুতেই তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারে না। উল্টে অন্যদের সাথে সুর মেলাবার পরিবর্তে সে নানা প্রশ্ন করে। উচ্চাকাঙ্খার উদযাপন যেখানে হয় এবং সেই উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদের প্রচার করে যারা আত্মসুখ ও গরিমা অনুভব করেন, দুটোর থেকেই উজান অনেক দূরেই বিচরণ করে। সে কখনোই সবার প্রিয় হতে চায় না। সস্তা জনপ্রিয়তার হাততালি কখনো উজানকে আকৃষ্ট করে না। ব্যক্তিপুজো বড় অপছন্দ উজানের। এসব কোনো "কোয়ালিটি" না থাকার কারণে উজানকে বিশেষ কেউ পছন্দও করে না, গুরুত্বও দেয় না। ব্যক্তিগত সীমানার পরিধিতে হাতে-গোনা কিছুজনকে নিয়েই ছিলো উজানের জীবন। তার মধ্যে দোলাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতো উজান। তার অনেক কারণও ছিলো, সেসব নেপথ্যের ঘটনা অলিখিতই থাক।
জীবনে ঘটবার মতো ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঘটে। সেরকমই অপ্রত্যাশিত ছিলো উজান ও দোলার হঠাৎই আলাপ। কিছুটা নাটকীয়ও, উজান ঘটনাচক্রে দমকা হাওয়ার মত হাজির হয়েছিলো। পরিস্থিতি সেই আলাপ পরিচয়কে তরাণ্বিত করেছিলো আরো। দোলা তার একঘেয়ে, দমিত ও বদ্ধ জীবনের নানা কাহিনী উজানের সাথে শেয়ার করতো আর উজান বিস্ময়ে সেসব শুনতো ও বিশ্বাস করতো। সেই বিশ্বাসের মধ্যে একটা শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা ছিলো। গুমোট দিনের শেষে আচমকা এক পশলা বৃষ্টির পর ঘরের জানালা খুলে দিলে সেই হাওয়ায় যে একটা অননুভূত পরম তৃপ্তির অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতির রেশ নিয়েই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। ক্রমে সেই জানালা দিয়ে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, পড়াশোনা, সিনেমা, আধুনিকতা ইত্যাদি নানাবিষয়ে খোলা হাওয়ার স্রোত বইতে শুরু করে। অনাস্বাদিত সেই ভালো লাগার মুহূর্তগুলো উজান কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতো না। কিন্ত সেই স্রোতের অর্থ দুজনের কাছে ছিলো ভিন্ন। উজান অচিরেই বুঝতে পারে যে একজনের স্রোতের অনুকূলে বয়ে যাওয়ার স্বভাব ও অন্যজনের স্রোতের প্রতিকূলে যুঝবার চেষ্টা কখনোই একই কেন্দ্রাভিমুখী হতে পারে না। তবুও উজান দোলার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারতো না। পরিস্থিতি বা পারিপার্শ্বিকতা একটা কারণ ছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রথম পরিচয়ের সেই দিনগুলোতে দোলার ডাকের মধ্যে একটা উষ্ণতার আহ্বানও থাকতো। দুজনেই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা কথাবার্তা বিনিময় করতো।
দোলা তার জীবনের নানারকম বিশ্রী ও তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উজানকে বলতো। যে বা যারা সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণ, তাদের কথাও বলতো। ক্রমে উজানের প্রথম ও প্রধান প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল দোলা। সময় বহমান আর সেই বহমানতা একমুখী নয়। উজান খেয়াল করতো যাকে বা যাদের নিয়ে দোলার এত অভিযোগ, দোলার এত তিক্ত অভিজ্ঞতা, তার বা তাদের সাথে মেলামেশায় দোলা খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং আগ্রহীও। উজানের খটকা লাগার সেই শুরু। দোলার কথাবার্তা থেকে উজান এটা বুঝতে পারতো যে দোলার পয়সাওয়ালা লোকজনদের প্রতি, ভোগবাদী জীবনের প্রতি, প্রাচুর্যের প্রতি, বিলাসবহুল জীবনের প্রতি একটা সহজাত আকর্ষণ ছিলো। তাই দোলার জীবনে প্রায়োরিটি ছিলো অন্য কিছু। প্রাচুর্যের সেই মোহময় জীবন উপভোগ করার জন্য দোলার তিক্ততার সঙ্গীসাথীদের দরকার ছিলো। প্রয়োজন যার বা যাদের দ্বারা মেটে, তাদের পেছনে সময় ব্যায় তো করতে হবেই, তাদের ডাকেও সাড়া দিতে হয়। তা না হলে প্রাচুর্যের হাতছানি অধরাই থেকে যায়। সেদিক থেকে উজান একদমই লাভজনক ছিলো না। কিন্তু দোলার কথা বলার একটা লোকের বড় প্রয়োজন ছিলো সেইসময় আর স্বীকৃতিহীন উজান ছিলো দোলার সেই প্রয়োজন শুধু। উজান বুঝতে পারতো যে দোলার এই প্রয়োজন সাময়িক। দেখাশোনা আর চেনাজানার মধ্যে একটা বড় ফারাক আছে। দোলা দেখাশোনার মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে চাইতো সবকিছু। তাই উজান নিজের স্বভাববশত দোলার থেকে দূরত্ব রেখে চলার চেষ্টা শুরু করে। হয়তো কিছুটা পেরেওছিল সাময়িক। কিন্তু সবকিছু উজানের হাতে ছিলো না। আসলে এমন কিছু সামাজিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিকতা বা পরিস্থিতি কখনো কখনো তৈরী হয় যে চাইলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। উজান সেরকমই একটি অবস্থার ঘুর্ণিতে পাক খাচ্ছিল আর দোলা সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে যাচ্ছিল। দোলার বাচনভঙ্গির মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক স্টাইল ছিলো যে কপটতা টের পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। ঠিক যতোটুকু ও যেভাবে উজানকে প্রয়োজন ছিলো, দোলার কথাবার্তা বা মেলামেশা ঠিক ততটুকুই মাপা ছিলো। দোলা অনেককিছুই উহ্য রেখে দিতো কিন্তু উজানের কাছে কোনোকিছুই গোপন থাকতো না। কিন্তু ওই যে কথায় বলে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু। তাই সুযোগ ও সুবিধে মতো দোলার মেলামেশাকে, সময় ও ক্ষেত্র বিশেষে দোলার উপেক্ষাকে উজান নিজেরই ভুল ভাবতো। আসলে ভুলটা ছিলো অন্য জায়গায়। দোলাকে গুরুত্ব দিতে দিতে উজান নিজেকে বড় সহজলভ্য করে তুলেছিল। আর সহজলভ্য যেকোনো কিছুই বড় সস্তা হয়, কোনো দাম থাকে না... সেখানে বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখাটা একধরনের কাল্পনিক বিলাসিতা মাত্র!
একটা সময়ের পর থেকে উজান দেখে যে দোলা ভীষণই দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের চেনা কথাবার্তার ধরণ পাল্টে যাচ্ছে, চালচলন বদলে যাচ্ছে, পরিচিতির বৃত্ত পাল্টে যাচ্ছে। অনেক ঘটনাই লুকিয়ে যাচ্ছে, অনেক ঘটনাই নিজের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে লঘু করে উপস্থাপন করছে। অজুহাত দেওয়াটা নিয়মে দাঁড়িয়েছে। অন্যদের নাম নিয়ে নিজের সীমাহীন প্রশংসা করে যাচ্ছে। নতুন বৃত্তে তার কতো গুরুত্ব বা তাকে কতো পাত্তা দেওয়া হয়, তাকে বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ ও নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসবার জন্য অন্যরা কতো জোরাজুরি করে, তার গুণের জন্য তাকে কতো আপন করে নিয়েছে, তার গুণের কতো কদর করে, সে কতো জনপ্রিয়, কিছু ব্যক্তিবিশেষ তাকে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দেয় যা আর অন্য কাউকে দেয়না - এসব শোনা উজানের প্রাত্যহিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দোলার কাছে সেটা সবকিছু "শেয়ার" করা ছিলো!! নতুন বৃত্তের লোকজনদের কত "কোয়ালিটি", গাড়ি বাড়ি সহ তাদের বৈভবের যাপন, যেনতেনপ্রকারেণ তাদের নির্লজ্জ প্রচার ও গুণগান, ব্যক্তিবিশেষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার অহংকার ও গর্ব- এসবও উজানকে শুনতে হতো। শোনাটাই উজানের কাজ ছিল, কোনোরকম প্রশ্ন বা আলোচনায় অলিখিত নিষেধ ছিলো। আরো আশ্চর্যজনক ছিলো যে, যার বা যাদের সম্পর্কে একদিন দোলা ভীষণ রকম তিক্ত বা মন্দ কথাবার্তা বলতো, যার বা যাদের জন্য দোলা নিজের জীবনের বারোআনাই নষ্ট গেছে বলে দাবী করতো, তারা যে কতো "কোয়ালিটির" অধিকারী, তারা যে কতো মহৎ, সেসবও উজানকে শুনতে হতো। উজানের অবস্থা হয়ে উঠেছিলো বড় অসহায়, না পারতো দোলাকে উপেক্ষা করতে, না পারতো এড়িয়ে যেতে। এড়িয়ে যেতে চাইলে উজানকে অভিযোগ বা দোষারোপ আর যোগাযোগ রাখলে আরো বেশি দোষারোপ!! আসলে নতুন বৃত্তে নতুন জীবনের এসব গল্প শোনাবার জন্য দোলার তখন আবার কাউকে খুব প্রয়োজন ছিলো। পুরোনো বৃত্তে নতুন জীবনের গল্প দোলার "ইমেজ" ধরে রাখবার পক্ষে অসুবিধেজনক ছিলো। সঙ্গত কারণেই দোলা উজানকে বেছে নিয়েছিলো কারণ উজান না ছিলো নতুন বৃত্তে, না ছিল পুরোনো বৃত্তে... বৃত্তের বাইরে ছিলো উজানের অবস্থান।
কেনোই বা দোলা উজানকে সব কথা বলতো বা বিভিন্ন ব্যাপারে উজানের মতামত চাইতো, কে জানে!! কিন্তু উজান খেয়াল করতো যে মতামত দিলেই দোলার নিদারুণ অবজ্ঞা ও অবহেলা। কিছুটা ব্যঙ্গও থাকতো। উজান দেখতো যে নতুন বৃত্তের কারোর সাথে উজানের পরিচয় সযত্নে এবং সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতো দোলা। অথচ নতুন বৃত্তে দোলার বাজারদরের গল্প উজানকে যেভাবেই হোক শোনাতে হবে। প্রথমদিকে উজান খুব অবাক হতো, কিছুই বুঝতে পারতো না। শুধু দোলার বদলে যাওয়াটা বুঝতে পেরে তাকে আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করে যেতো। শুধু দোলার কথা ভেবে নানারকম প্রশ্ন করে যেতো। কিন্তু নতুন বৃত্তে ঘনিষ্ঠ মেলামেশার পক্ষে দোলার অজুহাতের বন্যাও উজান অবাক হয়ে আবিষ্কার করতো। উজান খেয়াল করতো যে নতুন বৃত্তের আকর্ষণ এতই বেশি ছিলো দোলার জীবনে যে টাকাপয়সা, গাড়িভাড়া ইত্যাদির পেছনে দোলা দরাজ হাতে খরচা করতো। মাঝে মাঝেই উজানের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রাখতো না। বলা বাহুল্য, সে দোষও উজানের বলেই উজানকে শুনতে হতো কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনার পরেই অবধারিত ভাবে উজানকে সেটা শোনাতে হবেই, আর তার সাথেই যোগ করতো উজান যোগাযোগ রাখেনি বলেই সে আগে থেকে কিছু জানাতে পারে নি! আসলে উজানকে কিছু জানাবার কোনো দায় কখনোই ছিলো না দোলার। এই নতুন বৃত্তের লোকজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার, তাদের কাছে যাওয়ার জন্য দোলার সঙ্গীসাথীও ছিলো। আশ্চর্যজনক ছিলো যে, এই সঙ্গীসাথীদের সম্পর্কেই দোলা তার ভীষণই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উজানের সাথে একদিন শেয়ার করতো! আর উজান সেসবই বিশ্বাস করতো! নানা ঘটনায় উজান বুঝতে পেরেছিল যে সেই সঙ্গীসাথীরাই দোলার জীবনে সবকিছু, উজানের কোনো দাম নেই দোলার জীবনে। এমনকি দোলার ব্যক্তিগত স্বীকৃতিও ছিলো না। উজানের সাথে যোগাযোগ রাখাটা ক্রমে দোলার পক্ষে খুবই অসুবিধেজনক হয়ে পড়ছিল, দোলার সঙ্গীরাও চাইতো না। দোলাও আর চাইতো না! দোলা তার স্বভাবসিদ্ধ শৈল্পিক কথাবার্তার মাধ্যমে সেটা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিতো। অবজ্ঞা, অবহেলা, উপেক্ষার সাথে যোগ হলো তুলনা, অন্য পুরুষদের সাথে উজানের তুলনা... এরপর তাচ্ছিল্য - "সাইকোলজিকাল টরচার"... উজানের বেশ কিছু জায়গায় যাওয়া বন্ধ করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা। দোলার চারপাশে তখন বৈভবের ঝোড়ো হাওয়া, বিত্তের মিষ্টি গন্ধ, ব্যক্তিবিশেষের সাথে ঘনিষ্ঠতার উন্মুক্ত অহংকার, বৃত্তের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে দোলা। খোলা বাজারে নিজেকে বিক্রির প্রতিযোগিতা - যার যেমন চাহিদা, তেমন ভাবে দাম দিলেই হলো!
পোশাকআশাক, সাজগোজ ও আদবকায়দায় রপ্ত হওয়া, নতুন বৃত্তে ভীষণই দ্রুত আপন হয়ে যাওয়া ও অন্যদের আপন করে নেওয়া, তাদের সীমাহীন প্রশংসা, নির্দিষ্ট কিছু লোকজনের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্মাণ, ব্যক্তিবিশেষের স্তুতি ইত্যাদি দিয়ে যা শুরু হয়েছিলো, ক্রমে তা গড়াতে লাগলো নিয়মিত "মিট", "গেট টুগেদার", "পার্টি" , "ড্রিংক্স", "খাও - পিও - জিও" - এর জীবনে। দোলা উড়ছে তখন। উজানকে সময় দেওয়ার সময় নেই, অন্য কোথাও সময় দেওয়া আছে, নানা "ইনভলভমেন্টস", নানা "কমিটমেন্টস"-এ দোলা ভীষণ ব্যস্ত। এরপর এলো মধ্যরাতের "পার্টি"। ভোগ, বিলাস, ফুর্তির জীবনে গভীর রাতের আলোআঁধারির মায়াজালে নাচা-গানা, পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মদ খাইয়ে দেওয়া, ব্যক্তিবিশেষের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী থেকে নেশাতুড় রাতে গরম পানীয়র সাথে নরম যৌনতার উদযাপন - বেসামাল কিন্তু হিসেবী পদক্ষেপে বৃত্তের কেন্দ্রে পৌঁছাবার অশ্লীল আনন্দ। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের খোলা বাজারে দোলা উত্তাপ খুঁজে পায় অন্য পুরুষের বাহুলগ্না হয়ে। উজান বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে আবিস্কার করে পোস্টট্রুথ যুগে 'ভীষণ আদরে বেঁচে থাকে প্রেম নতুন কোনো ঠিকানায়'। শক্তি চাটুজ্জ্যে লিখেছিলেন '... পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে... মধ্যরাতে ফুটপাথ বদল হয়...' আর উজান অবাক হয়ে দেখেছিল মধ্যরাতে সম্পর্কের হাতবদল হতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিপি বদল হতে...। মালিক যখন পুরুষ হয়ে যায় তখন 'গোপনীয়তার মালিকানা' থাকে না। মালিকের নির্দেশ তখন পুরুষের আবদার হয়ে যায়। মার্কামারা মাতালরাও তো কারোর না কারোর পুরুষ হয়!!
এতো সবের পরও উজানের কাছে দোলার নিজেকে "ডিফেন্ড" করার চেষ্টা উজানকে হতবাক করে দিয়েছিলো। নিজের কাছেই নিজের পরাজয় দেখতে দেখতে উজান তখন বিধ্বস্ত, স্বাভাবিক জীবনের মূলস্রোত থেকে বহু দূরে। তখনও দোলা কি স্বাভাবিক! বিভিন্ন ঘটনাকে "জাস্টিফাই" করতে অবলীলায় একের পর এক মিথ্যে বলে যাচ্ছে, অন্যদের নামে দোষ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনোরকম আফসোস বা অনুশোচনাবোধ নেই, নিদেনপক্ষে লজ্জাবোধটুকুও নেই। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুচিন্তিতভাবে নিজের দরকার, প্রয়োজন, কার্যসিদ্ধি, লাভ, বিলাসিতা, শখ বা উচ্চাকাঙ্খার জন্য দোলা যেকোনো জায়গায় যেকোনো কারোর সাথেই যে সবকিছুই করতে পারে, সেটা খুব নগ্ন ভাবে প্রকট হয়ে পড়েছিলো। তবুও উজানের কাছে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার কি চক্ষুলজ্জাকর প্রয়াস! উজান যখন একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করলো, কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না দোলা, এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গ বদলানোর স্বভাবসিদ্ধ ও দক্ষ ভঙ্গিমাতে একটা সত্য ঢাকতে গিয়ে হাজারো মিথ্যে ফাঁকফোকড় দিয়ে বেরিয়ে এলো, লুকানোর আর কোনো জায়গা থাকলো না। "ডিফেন্ড" করতে গিয়ে নিজেকে আরো খেলো করে চলেছে দোলা, একদিন উজানের কাছ থেকেই শোনা "বিশ্বাস", "শর্ত", "ভালোবাসা" ইত্যাদি শব্দের কুৎসিত প্রয়োগ একনাগাড়ে শুনে চলেছে উজান। তখন সম্পূর্ণ অন্যরূপে দোলা। যে ভাষায় যে চূড়ান্ত অপমান উজানকে হজম করতে হয়েছিলো, তা ছিলো উজানের কল্পনারও অতীত। উজানকে আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা বানাতে দোলার সময় লেগেছিলো মাত্র একটা মুহূর্ত। অনুভূতি অবশ হয়ে গেলে আঘাতের তীব্রতা থাকে না বোধহয়। দোলার অকপট স্বীকারোক্তি ছিলো "সম্পর্কটা ভালো ভাবে শেষ করতে চেয়েছিলাম, এতো খারাপ ভাবে হবে ভাবিনি"। সম্পর্কও শেষ হয় ভালো ভাবে! শেখার কতকিছু বাকি ছিলো উজানের। যাক, দোলা যে সম্পর্কটা শেষ করতে চাইছিলো, সেটা অন্তত পরিষ্কার করেছিলো। সেটাই অনেক মূল্যবান শিক্ষা ছিলো উজানের কাছে।
জনপ্রিয়তার নেশা, উচ্চাকাঙ্খার নেশা, প্রাচুর্যের নেশা বড় সাংঘাতিক। বিত্তশালী পুরুষের গা ঘেঁষে থাকতে না পারলে এসব নেশা জমে না। বৃত্তের পরিধিতে অবস্থান করলে কেন্দ্রের থেকে দূরত্ব সময়ের সাথে সমান থেকে যায়, কখনো কমে না। তাই বেছে নিলো সেই পুরুষকেই যে পয়সা উড়িয়ে বৃত্তের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে। সেই নতুন পুরুষের সাথে দোলার হাসিমুখে আরাম আর তৃপ্তির নানান মুহুর্তের যুগল ছবিতে যখন সভাকক্ষ হাততালিতে ফেটে পড়ছে, উজান তখন সভাকক্ষ থেকে অনেক অনেক দূরে সেন্ট্রিফুগাল ফোর্সের ধাক্কা সামলাতে না পেরে বৃত্তের বাইরে ছিটকে পড়ে আছে। আধুনিকতার যে হাওয়ায় দোলা আর উজানের একান্ত ব্যক্তিগত একটি সম্পর্ক একদিন গড়ে উঠেছিলো, বিত্ত, বৈভব, জনপ্রিয়তা ও পয়সাওয়ালা পুরুষের নেশায় দোলা তাকে নিজের হাতেই মেরে ফেললো।
দোলারা মুখ ও মুখোশের ভারসাম্য সামলে সবার প্রিয় হয়ে জীবনের মূলস্রোতে থেকে জীবন উপভোগ করতে করতে আগামীর দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু স্মৃতি শেকল হয়ে যাদের আগামীকে অতীতে বেঁধে রাখে, দোষ তাদেরই হয়!
গান থেমে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই রাত শেষ হবে। উজান ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো। কোলাহলহীন, আলো ঝলমলহীন অদ্ভুতরকম শান্ত এক পরিবেশে নিস্তেজ, দাপটহীন রাস্তার আলোর মধ্যে দিয়ে যতদূর দেখা যায়, ঝাপসা চোখে উজান সেই নিঃসীম শূন্যতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে রইলো।

সুমন সিনহা
২৭/১০/২০২৩

No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...