কাল মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর যে অসহায় আর্তনাদ ও অকপট স্বীকারোক্তি শুনলাম ও দেখলাম, সেটা যে এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে ভাবতে পারিনি। বিশ্বাস ছিল সত্য একদিন সামনে আসবেই। মাত্র ১৪ বছরের মাথায়ও ইতিহাস রচিত হয়! সিবিআই, বিভিন্ন রকম কমিশন, আদালত যদিও অনেক আগেই ক্লিনচিট দিয়েছিলো। কাল চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক বিরোধী অবস্থানে থাকা একটি দলের ততোধিক বিরোধী নেত্রী ক্লিনচিট দিলেন। রাজনৈতিক ক্লিনচিট। আর যে বাপ-ব্যাটা কে দোষী, ষড়যন্ত্রীকারী ও গণহত্যার মূল হোতা বলে স্বীকার করে নিলেন, তারা মাননীয়ার একদা ছায়াসঙ্গী ও সদ্য অন্য একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন, যে দল সাদরে তাদের বরণ করে নিয়েছে!! হায়রে, ইতিহাস এত নির্মম হয়!
মাননীয়া তো স্বীকার করে নিলেন, কিন্তু সেদিন ওঁনার সাথে থাকা যে সকল বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী রেলজীবি বা পরজীবি, মিডিয়া যাদের ঘটা করে গালভরা নাম দিয়েছিলো বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ, একই সুরে গলা মিলিয়েছিলেন তারা আজ অদ্ভূত ভাবে নীরব কেনো। ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তাঁরা যে গণহত্যাকে সমর্থন করলেন, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল করার অপরাধে সেই দলের হাজার হাজার কর্মীর খুন করাকে, ঘরছাড়া করাকে, তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যে অভিযোগে মিথ্যে মামলা দেওয়াকে সমর্থন করলেন, তাদের সংসার কে ছাড়খার করে দিলেন, সেই দায় তাঁরা নেবেন না আজ? সেদিন যে মিথ্যে, ভুল ও অসত্য কে ক্রমাগত প্রচার করেছেন, আজকে ভুল স্বীকার করে সত্য প্রচারে এগিয়ে আসবেন না তাঁরা? মিডিয়াগুলো আজকে দায় নেবে না?
পাম অ্যাভিনিউয়ের আতিশয্যহীন দুকামড়ার ফ্ল্যাটের নিঃসঙ্গ সম্রাটের কিছুই ক্ষতি হয়নি সেদিন, আজও হয় না, একাধিক সিবিআই, কমিশন, আদালত ইত্যাদি বসিয়েও একটি আঁচড়ও কাটতে পারেন নি আজ পর্যন্ত। রাজ্য বা কেন্দ্রে কোথাও ওঁনার দলের সরকার ছিল না কিন্তু। উল্টে ওঁনার বাড়িতে বা হাসপাতালে ওঁনাকে দেখতে গিয়ে জাতে ওঠার প্রতিযোগিতায় সামিল হতে হয় অন্য দলের নেতা নেত্রী দের!! সেদিন উনি বা ওঁনার দল হেরে যান নি, হেরে গিয়েছিলো বাঙালি জাতি, হেরে গিয়েছিলো অসংখ্য বেকার বাঙালি যুবক যুবতীর স্বপ্ন, পিছিয়ে গিয়েছিলো ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ। সেদিন যাদের বয়স ছিল ১৮, আজ ১৪ বছর পর তাদের বয়স ৩২। সরকারী চাকরির বয়স আর তাদের নেই প্রায়। একটা গোটা বাঙালি প্রজন্ম হারিয়ে গেলো, নষ্ট হয়ে গেলো। এর দায় কে নেবে মাননীয়া?
শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের নেশায় নীতি নৈতিকতা, বাস্তববোধ, সততা সব কিছুকে ভুলে মিথ্যার বেসাতি ও হিসেববিহীন টাকার সাহায্যে কিছু মিডিয়া কে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলের দয়া দাক্ষিণ্যে আপনি ক্ষমতায় এলেন। দ্বিধাহীন ভাবে স্বীকার করছি সেই রাজনৈতিক দলের দায়ও কোনো অংশে কম ছিল না। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আপনি কি করলেন? সরকার চালানোর নামে নজিরবিহীন দুর্নীতি, তোলাবাজী, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের মিথ্যে মামলা দেওয়া, প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আনা ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা, সরকারি চাকরির নিয়মিত পরীক্ষাগুলো বন্ধ করে দেওয়া, দান খয়রাতি, ধর্মীয় তোষামোদ... কিছুই বাকি রাখলেন না। আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে আপনি খাল কেটে কুমির ডেকে আনলেন। আপনার দলের অধিকাংশ নেতা কর্মী আজ সেই কুমিরের দলে। আপনার দলে থেকে লুটেপুটে, চেটেপুটে সব কিছু খেয়ে আজ তারা অন্য দলে গেছে মানুষের জন্য কাজ করতে! সব বুঝে, সব জেনেও আপনি অন্ধ সেজে থেকেছিলেন এতদিন, আজ সেই কুমিরই আপনাকে গিলতে আসছে। বামপন্থীরা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়েছে, এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু বাকি প্রসঙ্গ গুলোও তো আজ ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রমাণিত। পারবেন অস্বীকার করতে? রাজনীতির কালবেলায় আজ আপনার অকপট স্বীকারোক্তিতে আক্ষেপ আছে, কোথাও হয়তো সত্য স্বীকার করে নেওয়ার সাহসও দেখিয়েছেন মেনে নিলাম। কিন্তু বিগত ১৪-১৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার যে পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলো, তার দায় কারা নেবে? যে রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের জন্য বাঙালি সবার কাছে সমাদৃত ছিল, তা আজ কলতলার ঝগড়া ও ধর্মীয় বাইনারি তে নেমে এসেছে। এ লজ্জা বাঙালির নয়?? এর দায় কাদের? পারবেন ১৪ বছর আগের পশ্চিমবঙ্গকে ফিরিয়ে দিতে যখন টাকা দিয়ে দলবদল হতো না, যখন টাকা বিলি করে ভোট ভিক্ষা চাইতে হতো না, যখন নিয়মিত সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হতো, যখন রাস্তাঘাটে নির্ভয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধাচারণ করা যেতো, যখন বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল করার জন্য কাউকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে ঢোকানো হতো না (আপনি নিজেই তার উদাহরণ), যখন ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে ভোট প্রচার হতো না, যখন রাজনৈতিক চেতনার বদলে গ্ল্যামার দিয়ে ভোট কেনার দেউলিয়াপনা দেখাতে হতো না।
শ্বেতশুভ্র ধূতি পাঞ্জাবির আপাদমস্তক ভদ্রলোকের দলের অনেক গাফিলতি ছিল, ভুল ছিল, কিছু বেনোজলও ঢুকেছিল। তারা সেটা স্বীকার করেছে, সংশোধন করেছে ও ৭% হয়েও মানুষের পাশে, মানুষের সাথে থেকেছে। পাম অ্যাভিনিউয়ের ঘরবন্দি ভদ্রলোকের দল ভুল ত্রুটি নিয়েও কিন্তু কখনো পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙালির সার্বিক মান কে নিচে নামতে দেয়নি। আপনার স্বীকারোক্তির সময় আপনার একদা সতীর্থরা অধিকাংশই আরো ক্ষমতার লোভে, আরো টাকার লোভে অন্য দলে! একবার যে স্বাদ পেয়েছে, তার থেকে দূরে থাকা যায়?!! যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমদানি আপনি পশ্চিমবঙ্গে করলেন তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে একটা সমগ্র জাতি কে, যারা একটু সুস্থ, সুন্দর শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে নিজেদের পরিবার নিয়ে শান্তিতে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলো। আপনার স্বীকারোক্তি শোনার পর থেকেই আপনারই গুণগ্রাহী (!) এক কবির একটা লাইন বারবার মনে আসছে - "মৃত নগরীর রাজা হয়ে কি হবে অয়দিপাউস?"
সুমন সিনহা
২৯/০৩/২০২১
No comments:
Post a Comment