Monday, April 26, 2021

বড়দিনের ডায়েরি

গতকাল বড়দিন চলে গেলো। আজকাল যে কোনো উৎসব এলেই কেমন একটা বিষণ্নতা বোধ হয়। উৎসব উদযাপনে অংশগ্রহণ করলেও কেমন একটা অপূর্ণতা থেকে যায়, কিছু একটা না পাওয়ার ব্যাপার অনুভূত হয়। অনেকটা ওই 'কি জানি কিসের লাগি, প্রাণ করে হায় হায়'। এবারে এই প্যান্ডেমিক ক্লান্ত বড়দিনে ঘরের মধ্যে সপরিবারে ছুটি ও উৎসব উদযাপন করতে করতে সেই অনুভূতি আরো প্রকট হল। নিজেকে মাঝে মাঝে কিছুটা বিচ্ছিন্নও মনে হলো।

আমার পুত্রের বয়স ছ'বছর। স্বভাবতই ওর উৎসাহ ও উদ্দীপনা অনেক বেশি। তার কারণও ভিন্ন। বাড়িতে একটা ক্রিসমাস ট্রী আছে। সেটাকে বের করে ঝাড়পোষ করা, তাকে ডেকোরেট করা, তারপর তার মধ্যে টুনি (লেড) লাইট লাগানো - এসবে ওর উত্তেজনার শেষ নেই। উপরিপাওনা হিসেবে এবারে ওর বিগদাদা আবার বিভিন্ন রঙের লেড লাইট জ্বলা একটা বেলুনও দিয়েছে। তাই উত্তেজনার পরিমাণও একটু বেশী এবারে। বিভিন্ন ভাষায় জিঙ্গিল বেল চালিয়ে ওর লাফালাফি, দাপাদাপি করা - এসব দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো। প্রাণের স্পন্দন দেখতে কার না ভালো লাগে। সকালবেলা কেক কাটাও হয়েছিলো।

কেক কাটার সময়ই ছোটবেলার কেককাটার স্মৃতি মনে এলো। আসলে এখন যে কোনো উৎসবের সময়ই আমাদের ছোটবেলার উৎসব যাপনের দিনগুলো মনে পড়ে যায় এবং অবধারিত ভাবে একটা তুলনা চলে আসে। আমার ছোটবেলার বড়দিন পালনের প্রধান অংশ ছিল সকালবেলা কখন কেক কাটা হবে আর মা বিকেলে কখন চার্চে নিয়ে যাবে। তখন বছরে ওই একদিনই কেক আনা হতো বাড়িতে। দু একবার ছাড়া কখনো আমার জন্মদিন পালন করা হয়নি আর জন্মদিনে কেক কাটার রেওয়াজ ছিল না। এখন তো সারাবছরই কেক পাওয়া এবং খাওয়া যায়। সহজলভ্যতা যে কোনো জিনিসেরই গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। তাই বড়দিন কে ঘিরে বছরে একবার কেক কাটার যে একটা রোমাঞ্চ ছিল, সেই রোমাঞ্চ কোথায় হারিয়ে গেছে। আমার ছেলের মধ্যেও কেক কাটার আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই। ওর কাছে কেক খাওয়াটা শুধু প্রাতঃরাশ ছিল।

আমাদের ছোটবেলায় সান্তাক্লজের নামটাম বিশেষ শোনা যেতো না। জিঙ্গিল বেল আমি শুনিনি। ক্রিসমাস ট্রী'র ফান্ডা জানা ছিল না। আর মোজার ভেতর সান্তাবুড়ো এসে উপহার সাজিয়ে দিয়ে যাবে - এমন রূপকথার জীবনে বড় হই নি। মেরি ক্রিসমাস উইশ করার বাতিক বা ফর্মালিটিও আমাদের বা বড়দের মধ্যে ছিল না। আমাদের মূল আকর্ষণ ছিল বড়দিনের তিন চার দিন আগে থেকে দোকানগুলোয় রঙিন কাগজে মোড়া বিভিন্ন রকমের কেক সাজানো দেখা। সেই দেখাতেই কি ভীষন খুশী আর আনন্দ। আর বাবার কাছে আব্দার ছিল কেক কিনতে যাওয়ার সময় যেনো আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল আরও কাছের থেকে রঙিন কাগজে মোড়া কেকগুলোকে দেখা। কিনবার পছন্দ আমার বা দিদির ছিল না। বাবা বা মা দাম অনুসারে যা কিনবেন সেটাই আমাদের আনন্দের কারণ। শুধু কেনার পর মনে হতো ইশ্ আরেকটু বেশি দাম দিয়ে যদি ঐ কেক টা কিনতো! কিন্তু শুধু মনেই, বলতে পারিনি কোনোদিন মুখে। এবারে যখন ছেলে কে বললাম যে চল্ কেক কিনে আনি, ওর সরল উত্তর ছিল 'বাড়িতেই তো মাইক্রোওয়েভ ওভেন আছে, ওখানে তো মাম্মা কেক বানায় প্রায়ই - বাইরে থেকে কেক কিনতে যাবে কেনো?' ওর এই সহজ উত্তরের মধ্যে ওর অজান্তেই কোথাও একটা প্রাচুর্যতার ইঙ্গিত আমাকে নাড়া দিয়েছিলো। জানিনা এটাকে 'rising of the proletariat' বলা বা ভাবা যায় কিনা! এখন তো উৎসব মানেই প্রাচুর্যতা ও দেখনদারি।আর ছিল বিকেলে মায়ের হাত ধরে আমার আর দিদির চার্চে যাওয়া। সেটাই ছিল বড়দিনের প্রধান আকর্ষণ। মফস্বল শহরের সাদামাটা চার্চ সেদিন আলোয় সেজে উঠত। ভেতরে মেরি মাতা ও যীশুর মূর্তি ও ছবি, মাটির তৈরী মেষশাবক, আলো দিয়ে তারা সাজানো - এসব অপলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতাম। মা যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার গল্প বলতেন, আমরা শুনতাম। বাড়ি ফিরতে মন চাইতো না। মা তাড়া দিলে বলতাম আর একটু, আর একটু। ভিড়ের মধ্যেও ঐ মেষশাবক গুলোকে বারবার দেখে যেতাম। মেরিমাতার কোলে যীশুকে দেখে একটা অদ্ভূত ভালোলাগা কাজ করত। চলে আসার সময় মনে হতো আবার একবছর পর এই চার্চে আসতে পারবো। কখনো আমাদের কে বলা হয়নি যে আমরা কোনও ধর্মীয় স্থানে যাচ্ছি। সেই বোধটাই কখনো আসেনি। ঠিক যেমন বড়দিনের কেক খাওয়ার সময় কখনো মনে হয়নি সেকুলার প্রমাণ করার জন্য কেক খাচ্ছি, সেমাইয়ের পায়েস বা বিরিয়ানি খাওয়ার সময়ও কখনো মনে হয়নি। উৎসবের আমেজ, উৎসবের মেজাজ, উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াতেই উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব নিহিত থাকে। ধর্মীয় সঙ্কীর্নতা উৎসবের প্রকৃতি বা চরিত্রের ওপর থাবা বসালে বিষণ্ণতা আসে না? আজকাল যে কোনো উৎসব কে ঘিরেই একটা সমান্তরাল ধর্মীয় প্রচার ও উস্কানি লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সাথে উৎসব পালনের ধরন বা রকম বদলাতেই পারে, তাই বলে উৎসবের আবেদন কি পাল্টে যেতে পারে?

এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেলও চলে গেলো। শীতের বিকেলের স্থায়িত্বই বা কতটুকু! সন্ধেবেলা পুত্রের দাবি বা আব্দারে ওর পুণের জেঠু, জেম্মা ও বিগদাদা এলো। পিকুর সম্মানে আরো একবার ওদের আনা কেক কাটা এবং খাওয়া হলো। একসাথে বেশ কয়েকটি ফটোও তোলা হল। ফটো তোলাও এখন কত সহজলভ্য! ছোটোবেলার বড়দিনের কোনো ফটো ফ্রেমবন্দী নেই। ওরা চলে যাওয়ার পর সেই আক্ষেপ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আবিষ্কার করলাম যে ২৫শে ডিসেম্বর নাকি 'গীতা জয়ন্তী'। এর আগে কখনো জানতাম না। আমার প্রিয় শহরের যে চার্চ নিয়ে এত স্মৃতি, সেই চার্চের সামনেই কিছুজন 'গীতা জয়ন্তী' উপলক্ষে 'গীতা বিতরণ কর্মসূচি' তে অংশগ্রহণ করে 'বড়দিন' পালন করেছেন! চার্চের সামনে ছাড়া অত বড় শহরে আর জায়গা ছিল না গীতা বিতরণ করার! এই আপাত 'ছোট্ট ঘটনা' টি সারাদিনের সুখানুভূতি গুলোকে একটা না-বোঝাতে পারা মনখারাপে ঢেকে দিলো। সেই বিষন্নতা ও গীতাপ্রাপকরা গীতা পড়বেন এই আশা নিয়ে প্রার্থনা করলাম বড়দিন শুভ বোধের হোক, বড় মনের হোক।

শুতে যাওয়ার সময় মহীনের ঘোড়াগুলি'র একটা প্রিয় গান শুনতে বড় ইচ্ছে হলো। তারই তিনটি লাইনের রেশ নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম...

"তবুও কিছুই যেনো ভালো যে লাগে না কেনো 
উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেনো 
কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও।" 

সুমন সিনহা
২৬/১২/২০২০

No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...