Tuesday, April 20, 2021

২৫শে জুন

১৯৭৫ সালের আজকের দিনে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সারাদেশে 'জরুরি অবস্থা' জারি করলেন। জনগণের সংবিধান - প্রণীত মৌলিক অধিকার খর্ব হল। চালু হল 'প্রেস সেন্সরশিপ'। ১৯৭৫ সালের ৩০ শে জুন 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিতব্য গৌরকিশোর ঘোষ মহাশয়ের নিয়মিত লেখা ছেঁটে ফেলা হল। বাতিল হল আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য লেখাও। গৌরকিশোর আবার লিখলেন, আবার বাতিল হল। রাষ্ট্র সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করল। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্র কেড়ে নিল। গৌরকিশোর ঘোষ প্রতিবাদ জানানোর এক অভিনব পন্থা বেছে নিলেন। তিনি মাথা ন্যাড়া করে ফেললেন। ওঁনার নিজের কথায় "আমি লেখক। আমার কলমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। আমার মাতৃবিয়োগের থেকে তা কোন্ অংশে কম?" ওঁনাকে মাথা ন্যাড়া দেখে কেউ একজন কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন 'এতেও কিছু না হলে?' ওঁনার নির্বিকার উত্তর ছিল "গলায় কুকুরের বকলস বেঁধে ঘুরব"।

যাই হোক, 'কলকাতা' পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত 'একটি বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যা'য় গৌরকিশোর ঘোষের ইতিপূর্বে সেন্সরবোর্ডে বাতিল হওয়া দুটি লেখা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সাথে তাঁর পুত্র কে লেখা একখানি চিঠি যেটি আপাতভাবে ব্যক্তিগত হলেও যার সামাজিক অভিঘাত বিপুল ছিল। আজকের দিনে কতজন এই সাহস দেখাতে পারবেন?? বলে রাখি এই পরিকল্পনায় নিজের থেকে যুক্ত হয়েছিলেন শ্রীশিক্ষায়তন কলেজের অধ্যাপিকা গৌরী আইয়ুব। অবশেষে পত্রিকা প্রকাশ হল এবং সরকার সেই পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো। রাষ্ট্র গৌরকিশোর বাবু কে বিপজ্জনক ঘোষণা করলো এবং তাঁকে আর গরাদের বাইরে রাখতে সাহস দেখালেন না তদানীন্তন সরকার। তাঁকে MISA (Maintenance of Internal Security Act) - য় বন্দি করা হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।
১৯৭৫ সালের ৬ই অক্টোবর ভোর রাতে কাশীপুর থানার বড়বাবু ( একটু বেসামাল অবস্থায়), দুজন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার ও দু তিন জন মজুর শ্রেণির লোক (যাদের সাক্ষী হিসেবে এনেছিল পুলিশ টিপ সই দেওয়ার জন্য! ) উপস্থিত হলেন গৌরকিশোর বাবুর বাড়িতে। প্রথামাফিক তল্লাশি চালানোর পর ওঁনাকে গ্রেফতার করা হল। ওঁনার সাক্ষী হিসেবে সেই ভোর রাতে উপস্থিত ছিলেন ওঁনার প্রতিবেশী নিমাইচন্দ্র দে শীল ও তাঁর স্ত্রী। জানিনা আজকের দিনে কতজন প্রতিবেশী বা পরিচিতজন এরকম বিপদের সময়ে সাক্ষী হতে উপস্থিত হবেন বা হতে পারবেন!!

পরবর্তী একবছর গৌরকিশোর বাবুর ঠিকানা হয় এমারজেন্সী মিসা কয়েদী হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলের দশ নম্বর সলিটারী সেল। প্রথমে তাঁকে B-Class Prisoner হিসেবে জেলে রাখা হয়। স্ত্রী শীলা দেবীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত C-Class Prisoner এর তকমা জোটে। এই সময়েও তাঁর কলম রাষ্ট্র বন্ধ করতে পারেনি। যদিও সমস্ত লেখা তাঁর পাহারাদারদের দেখাতে হতো। মানে censored। জেলখানার এই কড়াকড়ির মধ্যেই অতি সংগোপনে তাঁর দুটি লেখা পাচার হয়ে বাইরে আসে। প্রথমটি 'প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি' (ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ওপর) ও দ্বিতীয়টি 'দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা!' দ্বিতীয় চিঠিটি ১৯৭৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালীন প্রচারিত হয়। অনুমান করা যায় নিরাপত্তারক্ষীদের কিছুটা নরম মনোভাব ও শুভান্যুদায়ীদের সহযোগিতা ছাড়া এ কাজ সম্ভব ছিল না কোনোভাবেই। আজকাল এরকম শুভান্যুদায়ী কি পাওয়া যায়?? কিভাবে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানা সংবলিত লেখা দুটি জেলের বাইরে গেলো - এনিয়ে শোরগোল পরে যায়। এরই প্রতিক্রিয়ায় ওঁনার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি সপ্তাহে একদিন যে স্ত্রী-র সঙ্গে সাক্ষাৎকারের দিন, সেটাও কিছুদিন স্থগিত রাখা হয়।!!

কোনো একসময় ওঁনাকে লর্ড সিনহা রোডের অফিসে পুলিশ অফিসার অম্বিকা ভট্টাচার্যের সামনে হাজির করা হয়। নিজের অফিসে অম্বিকা বাবু 'ইন্টারোগেট' করার নামে দরজা বন্ধ করে, বাইরে লালবাতি জ্বালিয়ে রেখে ওঁনার খাবারের ও ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন কারণ দিল্লী থেকে তখনও আদেশনামা এসে পৌঁছয় নি। আচ্ছা, এখনকার সময়ে এরকম পুলিশ অফিসার কি সত্যিই আছে? ইচ্ছা থাকলেও কোনও পুলিশ অফিসার যদি এটুকু করেন কি হতে পারে তাহলে।

শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি জেলেই তাঁর তৃতীয় হার্ট অ্যাটাক টি হয়। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে পি. জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করলেন। খবর পেয়ে ওঁনার বাড়ির লোকজন ও সাংবাদিক সুদেব রায়চৌধুরী যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন, দেখলেন হৃদরোগ বিভাগের দোতলায় লিফ্টের সামনে মেঝেতে শোয়ানো আছে ওঁনাকে।! দিল্লী থেকে চিকিৎসার অনুমতি না আসায় মিসা- বন্দির চিকিৎসা শুরু হতে পারছে না!! অবশ্য অনুমতি আসার পরে চূড়ান্ত তৎপরতা দেখা গিয়েছিলো।!! হৃদরোগে আক্রান্ত হলেও তো উনি মিসা-বন্দী কয়েদী! তাই জেলের নিয়মেই হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা। পুলিশ ঘিরে ফেললো রোগীর শয্যা। এস.এস.কে.এম হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের তদানীন্তন প্রধান ও ওঁনার ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ড. এ. বি. মুখার্জী রোগীর বিছানা ঘিরে এত পুলিশ দেখে চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেন। সরকার পুলিশ সরাতে বাধ্য হয় ও ঘরের বাইরে পাহারায় বসায়। ভাবুন তো একবার যে বর্তমান সময়ে কোনো সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক পুলিশি পাহারার আতিশয্য দেখে রোগীকে চিকিৎসার সরকারি নির্দেশ অমান্য করছে!! যাক্ গে, জেলের নিয়মেই দেখা করতে হতো ওঁনার সাথে, অর্থাৎ সপ্তাহে একদিন। তবে সরকারি নিয়ম কে পাশ কাটিয়ে নানারকম বেআইনি পথে ওঁনার দুই কন্যা কে ওঁনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতেন সেই পাহারাদার পুলিশরাই। এখন পারবে পুলিশরা?!! পাহারাদাররা বহু সুখ দুঃখের কথা, এমনকী পারিবারিক সমস্যার কথাও ওঁনাকে বলতেন!! জুনিয়র ডাক্তারদের অনেক আবদারও উনি মিটিয়েছেন। তাঁরা এখন অনেকেই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক।
একটু সুস্থ হতেই ওঁনার সাংবাদিক সত্বা আবার জেগে উঠল। তাঁর নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের কত খরচ হচ্ছে সেটা জানতে উনি উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। শুধুমাত্র হাসপাতালে পাহারা দেওয়ার জন্য প্রায় ৮০,০০০/- টাকা খরচ হয়। স্বৈরতন্ত্রের খেসারত!! ১৯৮১ সালের মে মাসে উনি যখন চতুর্থ বারের জন্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঐ একই হাসপাতালে ভর্তি হন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় 'অসুস্থ বন্ধু' কে দেখতে হাসপাতালে যান এবং সেই সময় উনি সিদ্ধার্থ বাবু কে এই খরচের হিসেব টা দিয়েছিলেন।

জেলে বন্দি অবস্থায় ও হাসপাতালে অন্তরীণ অবস্থায় উনি অনেক লেখালেখি করেছিলেন। চিঠিপত্র, নানান বিষয়ে মতামত, টুকরো চিন্তা ইত্যাদি যখন যেমন পেরেছেন চিরকুটে, বইয়ের পাতায়, হাসপাতালের ছোট প্যাডের কাগজে লিখেছিলেন। অনেক লেখাপত্র হারিয়ে গেছে, বন্ধুদের লেখা অনেক চিঠি চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায়নি। বিশেষত গৌরী আইয়ুব কে লেখা মূল্যবান চিঠিগুলোও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঋণস্বীকার: দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা, গৌরকিশোর ঘোষ। কৃতজ্ঞতা জানাই আনন্দ বিপণীর সেই অপরিচিত ভদ্রলোক মহাশয় কে যিনি এই বই টি সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

পুনশ্চ : সরকারি নিয়মে প্রেসিডেন্সি জেলে গৌরকিশোর বাবুর 'অ্যাটেনড্যান্ট' ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামী!! যাঁর বউ ওঁনার স্ত্রী কে অনেক খবরও দিতেন।


সুমন সিনহা
২৫/০৬/২০২০



No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...