Sunday, April 18, 2021

বাংলা টা ঠিক আসে না

বেশ কিছুদিন আগে বাংলা ভাষার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নিয়ে একটি জনপ্রিয় বিতর্ক সভায় চন্দ্রিল বাবু শ্লেষের সাথে বলেছিলেন "... 'কেনকী' আমরা বাংলা ভাষা কে খুব ভালোবাসি..."। এই 'কেনকী' বলে বাংলায় কোনো শব্দ নেই। হিন্দি তে 'কিঁউকী' বলে একটা শব্দ আছে, সেখান থেকে সটান 'কেনকী' এখন আর কেউ কারণ বলেন না বা বলতে চান না! এবং ক্রমাগত এই ধরণের ভাষা বা শব্দের ব্যবহার ও ব্যবহারের প্রবনতা বাড়ছে। বুঝে বা না বুঝে। এই অর্থহীন বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাংলা ভাষাকে শুধু রিক্তই করছে না, গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। 'দিওয়ালী' বা জন্মদিন 'মানানো' এখন অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের। আমরা আর দীপাবলী বা জন্মদিন পালন করিনা। এই জন্মদিন প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো এখন দেখি যে একটা বড় অংশের বাঙালি শুভ জন্মদিন বলে আর শুভেচ্ছা জানায় না। তারা 'হ্যাপিওয়ালা বার্থডে' বা 'হ্যাপিওয়ালা অ্যানিভার্সারী' বলে ভীষণ আরাম পায়। বিন্দুমাত্র কিছু না ভেবে টুপ করে একটা হিন্দী বা ইংরেজী শব্দ তুলে নিয়ে খুব আনন্দের সাথে, গর্বের সাথে তার প্রয়োগ শুধু বিরক্তিকরই নয়, হাস্যকরও বটে। এদের মধ্যে অনেকে আবার ভাবেন একটা নতুন কিছু ভাবে তো শুভেচ্ছা জানানো গেলো!! সবাই যে সচেতনভাবে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে এইসব প্রয়োগ করেন তা কখনোই বলছি না আমি। কিন্তু আমরা যদি একটু সচেতন হই বা সাবধান হই বা একটু ভাবি, তাহলে এই অসুন্দর বা শ্রুতিকটূ বাংলা ভাষার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে পারি। অনেক সময় এই ধরণের প্রয়োগ তার অর্থ কেও সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তন করে দেয়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একই জিনিস ক্রমাগত দেখতে দেখতে বা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে হিন্দি তে বলা হয়ে থাকে 'ঠক গয়া হু' কিছুদিন আগে দেখলাম একজন কোনো এক প্রেক্ষিতে লিখছেন "এই একই জিনিস শুনতে শুনতে 'ঠকে' গেছি"। পরে বুঝলাম উনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন বলতে চেয়েছেন! এখন বাংলাতে ঠকে যাওয়া বলতে প্রতারিত হওয়া বোঝায়।এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে। তাহলে বুঝুন এই প্রবণতা কি ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই ধরণের প্রয়োগে কি বাংলা ভাষার সৌন্দর্য বা মাধুর্য কোনো ভাবে বাড়ে? আসলে আমরা বাঙালিরা আজকাল হিন্দি তে ভাবতে শিখে গেছি। আর তাই হয়তো বাংলা নিয়ে ভাবার সময় নেই। প্রবাসে থেকে আমি দেখেছি বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা বা গল্প করার সময় বাঙালি সংস্কৃতি বা বাঙালির অতীত নিয়ে খুব গর্বিত কিন্তু  এই রকম অসংখ্য হিন্দি মিশ্রিত বাংলা বলে যাচ্ছেন, উচ্চারণ করছেন, ভুল অনুবাদ করছেন, ভুল ব্যবহার করছেন, ভুল বানান লিখছেন। দুঃখের বা আক্ষেপের বিষয় হলো যে এঁদের অনেকেই নিয়ম করে একুশে ফেব্রুয়ারি তে শুভেচ্ছা জানান বা ছোটোখাটো বাঙালি আড্ডায় ভবানী বাবুর "বুঝলেন দাদা, আমার ছেলের বাংলা টা ঠিক আসে না" কবিতা পাঠ করেন!! এসবের সাথে কেমন একটা মানিয়ে নিয়েছেন বা মেনেও নিচ্ছেন হয়তো। এই মানিয়ে নিতে নিতে বাংলা ভাষাটাকে খুব সস্তা করে দিয়েছি আমরা। আর সস্তা হয়েছে বলেই তাকে সহজেই অবহেলা বা অনাদর করতে পারি বা 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' ধরে নিতে পারি। কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত ও পছন্দের মানুষ আমাকে বললেন তাঁর কাজের 'বাই' কিছুদিন ধরে আসছে না। কানে লাগলো বলে তাঁকে বললাম কাজের মাসি বা কাজের লোক বা কাজের দিদি না বলে 'বাই' বলছেন কেনো? উনি বললেন "বুঝেছি কি বলতে চাইছেন কিন্তু আসলে ওই অভ্যেস হয়ে গেছে আর কি"। বেশ কিছুদিন আগে একটি নামকরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপনে 'responsive' এর বাংলা অনুবাদ করেছিলো 'প্রতিক্রিয়াশীল'! ভেবে দেখুন একটা ভালো বাংলা অনুবাদ করা লোক কে পয়সা দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য সেই ব্যাঙ্কের যথেষ্ঠই আছে, কিন্তু ওই যে বললাম 'টেকেন ফর গ্রান্টেড', গুরুত্বহীন করে দিচ্ছি আমরা। দিনে দিনে বাংলা শব্দের উচ্চারণ শৈলীও বদলে যাচ্ছে অনেক বাঙালির কাছে। সৌরভ কে 'সওরভ', পরোটা কে  'পরাঠা', জিলিপী কে 'জলেবী' বলতে না শুনতে ভালো লাগে? এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার বা শব্দের নতুন নতুন প্রয়োগও খুব বিস্ময়কর। যেমন 'ভোট করুন', 'খাবার লাগিয়ে দিই' অনেকে হয়তো বলবেন পরিবর্তন তো সময়ের নিয়ম। কালের নিয়মে, সময়ের সাথে সাথে নিশ্চয়ই পরিবর্তন কাম্য। আর বিগত কয়েক বছর থেকে বর্তমান কাল অবধি বাঙালি সমাজ জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও আলোচ্য শব্দ বোধহয় পরিবর্তন। কিন্তু দয়া করে পরিবর্তন আর বিকৃতি কে সমার্থক করে দেবেন না। বাংলা ভাষার এই সস্তা হয়ে যাওয়ার পেছনে বাজার অর্থনীতির একটা বড় ভূমিকা আছে যা আমাদের অবচেতনে এই ভাষার প্রতি একটা উদাসীনতা, একটা নির্লিপ্ততা তৈরী করছে। বাংলা ভাষা তো বাঙালি সত্তার অংশ, বাঙালি সংস্কৃতিরই অঙ্গ। আসুন না আমরা সবাই মিলে এই ভাষার প্রতি একটু যত্নবান হই, একটু সচেতন হই। আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের নিজস্বতা, আমাদের স্বকীয়তা কে যদি আমরাই ধরে রাখতে না পারি, তাহলে কারা রাখবেনআসুন না ভাষাটা কে একটু আদর করি, একটু ভালোবাসি। আমরা চেষ্টা করি 'হোলি' না বলে দোল বলতে, 'হ্যাপি দশেরা' না বলে শুভ শারদীয়া বা শুভ বিজয়া বলতে, 'রসগুল্লা' না বলে রসগোল্লা বলতে, 'বঙ্গাল' না বলে বাংলা বলতে, পয়লা বৈশাখে 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' না বলতে। আসুন না আমাদের ছেলে মেয়েদের, ভাই বোনদের আমরা বাংলা ভাষা কে শিখতে, জানতে উৎসাহিত করি। যে ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে আমাদের পূর্বসুরীরা নিহত ও আহত হলেন, যে ভাষার স্মৃতিতে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করলো, সেই ভাষার ঐতিহ্য, মর্যাদা ও কৌলিন্য রক্ষার দায় তো আমাদেরই। বাংলা ভাষা যে সস্তা হয়ে গেছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে সস্তা বা কমদামী মদ কে আমরা 'বাংলা' মদ বলে থাকি। আমরা যদি এই ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য সবাই মিলে এগিয়ে না আসি তাহলে অচিরেই বাংলা ভাষার 'বাংলা বাজার' দেখে আমরা শান্তিতে ঘুমাতে পারবো তো? ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে তো?

পুনশ্চঃ আজকাল দেখছি ইংরেজী অক্ষরে বা হরফে বাংলা লিখলে অনেকে 'রোমান বাংলা' বলে ব্যঙ্গ করছেন। আমার মনে হয় জগাখিচুরী বাংলা লেখার থেকে ইংরেজী হরফে বাংলা লেখা অনেক ভালো। তবে এটাও মনে করি ইংরেজী হরফে বাংলা বানান লেখার একটা নিয়ম বা বিধান থাকা উচিত। আর একটা কথা বলি। আজকাল বাংলায় টাইপ করার অনেক কীবোর্ড অ্যাপস্ আছে। আমাদের মোবাইলে নানা রকমের অ্যাপস্ থাকে। একটা বাংলা কীবোর্ডের অ্যাপস্ থাকলে ক্ষতি কি? আসুন না নিয়মিত না পারলেও মাঝে মাঝে আমরা বাংলা ভাষা টাইপ করে লিখি। এভাবেই একদিন আমাদের অভ্যাস হয়ে যাবে হয়তো।


সুমন সিনহা
২৫/০১/২০২১



No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...