Tuesday, April 20, 2021

আন্তর্জাতিক (শ্রমজীবি) নারী দিবস : ইতিহাস ও বাস্তবতা

১৯০৯ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারী 'সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা' প্রথম নারীদের অধিকারের দাবী তে 'জাতীয় নারী দিবস' পালন করেন। মহিলা বস্ত্র শ্রমিকদের সমবেতনের অধিকার ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ঠিক পরের বছর আগস্ট মাসে 'আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে' জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন সহ আরো কিছু মহিলা প্রস্তাব দেন নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার দাবী তে প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হোক। যদিও তারিখ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি। তারও পরের বছর অর্থাৎ ১৯১১ সালের ১৯ শে মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানী ও সুইটজারল্যান্ডে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে মহিলাদের ভোটাধিকারের (suffrage) দাবী তে সোচ্চার হয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস (কোনো সরকারী স্বীকৃতি ছাড়া) পালন করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াই। ১৯১৪ সালের ৮ই মার্চ জার্মানীতেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় শুধুমাত্র মহিলাদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবী তে অর্থাৎ লিঙ্গসাম্যের দাবী তে। ১৯১৩ - ১৪ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর একটি প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে।


আমেরিকা ইউরোপ ছেড়ে এবার সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে চোখ রাখা যাক। ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ। রাশিয়ার রাজধানী পেত্রোগ্রাদে মহিলা বস্ত্র শ্রমিকরা সমবেতনের দাবী তে আন্দোলন শুরু করেন। এটাই ছিল ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সূচনা যা পরবর্তী কালে অক্টোবর বিপ্লব সহ রুশ বিপ্লবের জন্ম দেয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে মহিলা বস্ত্র শ্রমিকরা 'রুটি ও শান্তি'র (bread and peace) দাবী তে ধর্মঘট শুরু করেন, যে ধর্মঘটের দাবিদাওয়া ছিল মূলত তিনটি - প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান, রাশিয়ার খাদ্য সঙ্কটের অবসান ও জারতন্ত্রের অবসান। খেয়াল করতে হবে যে শ্রমজীবী মহিলাদের এই আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকারের সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারকেও জুড়ে দেয়। মহিলা বস্ত্র শ্রমিকদের এই ধর্মঘট অচিরেই সাধারণ ধর্মঘটের (mass strike) চেহারা নেয় ও সাতদিন পর জার নিকোলাস II পালিয়ে যান ও অন্তর্বর্তী সরকার মহিলাদের ভোটাধিকারের অনুমতি দিতে বাধ্য হন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ১৯১৮ সালে জার্মানীতেও মহিলারা প্রথম ভোটাধিকারের সুযোগ পান। যাইহোক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পাওয়া মানেই মহিলাদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও সামাজিক অবহেলা শেষ হয়ে যাওয়া নয়। মূল উদ্দেশ্য এক রেখে অর্থাৎ লিঙ্গসাম্যের দাবী তে প্রতিবছরই বিভিন্ন দেশে, মূলত সমাজতান্ত্রিক ও কম্যুনিস্ট দেশগুলোতে, এর পর থেকে ৮ই মার্চ (বা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার) আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মহিলা দিবস পালিত হতে থাকে। ১৯৬৭ সাল থেকে নারীবাদী আন্দোলন আবার নতুন মাত্রা পায়। এই সময় নাগাদ (ষাট - সত্তরের দশক) মূলত পশ্চিমী দেশগুলোতে Second Wave Feminism শুরু হয়। এই সময়ে লিঙ্গসাম্য ও নারীর অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন গুলো বামপন্থী ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হয় ও নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে সোচ্চার হয়। দাবিদাওয়া গুলি ছিল - সমবেতনের অধিকার (rights for equal pay), সমান অর্থনৈতিক সুযোগের অধিকার (equal economic rights), প্রজনন অধিকার (reproductive rights), ভর্তুকিযুক্ত শিশুযত্ন (subsidized child care), মহিলাদের বিরুদ্ধে সমস্ত রকম হিংসার প্রতিরোধ (prevention of violence against women)। এই সব দাবিদাওয়া গুলোই নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার রক্ষার দাবী। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ৮ই মার্চ জাতিসংঘ (United Nations) 'আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস' কে স্বীকৃতি প্রদান করে। তার আগে অবধি তা মূলত সমাজতান্ত্রিক ও কম্যুনিস্ট দেশগুলোতেই গুরুত্ব সহকারে পালিত হতো। এর পরে ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (United Nations General Assembly) তার সদস্য রাষ্ট্রদের কাছে নারীর অধিকার (women's right) and বিশ্বশান্তি (world peace) রক্ষার জন্য 'জাতিসংঘ দিবস' (UN Day) ৮ই মার্চ কে ঘোষণা করার আহ্বান জানায়। আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষনীয় যে এরপর থেকেই 'আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস' থেকে 'শ্রমজীবী' শব্দ টা বাদ চলে যায়!! যাক গে, উত্তরাধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ইতিহাস দেশে বা বিশ্বে নতুন কিছু নয়। মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে না গেলেই হলো।
এবার একটু একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন দেখা যাক। মহিলাদের ভোটাধিকার বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় স্বীকৃত। তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার বিষয়দুটি দেখা যাক। আজকের সময়ে নারী দিবস উদযাপন ধনী কর্পোরেট সংস্থা গুলো দ্বারা স্পনসরড্ এবং প্রধানত একটা ফিল-গুড বার্তা ছড়িয়ে দিতে সচেতন ভাবে সচেষ্ট। তাই যে বৈপ্লবিক সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে নারীদের অধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, পণ্যায়নের মুক্ত বাজারে তার অর্থই পাল্টে গেছে। মনে রাখতে হবে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এবং এই দুই অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই লিঙ্গ - অসাম্য দূর হতে পারে। নারী দিবসের পণ্যায়ন আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী আলেকজান্দ্রা কোলনতাই এর বিখ্যাত কথাগুলি - " Women’s world is divided, just as is the world of men, into two camps; the interests and aspirations of one group bring it close to the bourgeois class, while the other camp has close connections with the proletariat, and its claims for liberation encompass a full solution to the woman question." শ্রেণীবিভক্ত সমাজে লিঙ্গসাম্যের দাবী তে লড়াই করতে গিয়ে কিছু স্বাবলম্বী মহিলা পণ্যায়নের স্রোতে ভেসে গিয়ে এই সারসত্যটিই ভুলে গেছেন। সেই অ্যাসপিরেশনের টানে সমাজের একটা বড় অংশের মহিলাদের বা প্রান্তিক শ্রমজীবী মহিলাদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে যখন দেখি কিছু মহিলা ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে সক্ষম হওয়াকেই অর্থনৈতিক অধিকার প্রাপ্তি বলে মনে করেন, তখন বড় হতাশ লাগে। নিজের উপার্জন টাই বড় কথা, কত বেশী বা কত কম উপার্জন, সেটা অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার নিয়ন্ত্রক হতে পারে না। হয়তো 'শ্রমজীবী' শব্দটা বাদ না গেলে এত সহজে এই উল্লাস দেখানো যেতো না। এখানেই সামাজিক অধিকারের প্রশ্ন টা এসে যায় কারণ সামাজিক অধিকার উপার্জনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না। আর এখানেই লিঙ্গসাম্যের গুরুত্ব নিহিত আছে। সেক্স (যৌনতা) আর জেন্ডার (লিঙ্গ) কে গুলিয়ে দেওয়ার একটা প্রবনতা সবসময় লক্ষ করা যায়। সেক্স হল একজন মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যাকে জৈবিক বা জীবতত্ত্বিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় (biologically defined)। আর লিঙ্গ হল একজন মানুষের সামাজিক আইডেন্টিটি (socially constructed features) যা নির্ধারণ করে সমাজে তার আচার ব্যবহার, আশা আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা। তাই যৌন পক্ষপাতের (sexual biasness) বিপক্ষে লড়াই করার চেয়ে লিঙ্গসাম্যের (gender neutrality) পক্ষে লড়াই করা টা অনেক বেশী জরুরী। আর এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে আজকের মহিলাদেরই, সে যে সামাজিক স্তরেই থাকুক না কেনো। কোনো শিল্পপতির স্ত্রী বা কোনো মহিলা মন্ত্রী বা কোনো ক্রিকেট টিমের মালকিন (অর্থাৎ কোনো ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠিত মহিলা) কে উদাহরণ করে উল্লাসে মাতামাতি করলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উদ্দেশ্য বা গুরুত্ব দুটোই নষ্ট হবে।
নীচের ছবিটি ১৯১৪ সালের ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের একটি পোস্টার যে টি তখন জার্মানী তে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। ছবি টি উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত।
নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন, রোজা লুক্সেমবার্গ, আলেকজান্দ্রা কোলনতাই সহ সকল নামী অনামী মহিলাদের আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের শ্রদ্ধা জানাই। খেটে খাওয়া মেয়েদের লড়াই জারি থাকুক।


সুমন সিনহা
০৮/০৩/২০২১



1 comment:

Unknown said...

Bah...sundor likhecho.

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...