Sunday, April 18, 2021

একটি কাল্পনিক চিঠি


প্রিয় অস্পর্শিনী,

কিছুদিন আগে অঞ্চিত ফোন করেছিলো। মাঝেমধ্যেই ওর সাথে কথা হয় অবশ্য। শুনলাম তোদের হঠাৎ দেখা হয়েছিল এর মধ্যে। তুই নাকি আমার সম্পর্কে অনেককিছু জানতে চেয়েছিলিস ওর কাছে! তোদের দুজনার স্মৃতিচারণার আড্ডার সবিস্তার বিবরণ শুনে বেশ ভালো লাগলো। একেই প্রবাসে থাকি, তার ওপর চল্লিশও পেরিয়ে গেছি। তাই স্মৃতির সাথে আড্ডা দেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরেই এই পত্রমিতালী। হয়তো বা তোর অনেক কৌতুহলের উত্তরও দেওয়া হয়ে যাবে এই ফাঁকে, আর তোকেও তৃতীয় কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।
যাক গে, চল্লিশ পেরোলেও এখনও চালসে পড়ে নি। হ্যাঁ, চশমার মাইনাস পাওয়ার সামান্য বেড়েছে আর সাথে প্লাস পাওয়ারও যোগ হয়েছে। কাছের জিনিস পড়তে বা দেখতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছিল, তাই ডাক্তার প্লাস পাওয়ারও দিয়েছে। আর 'বয়স হওয়ার মানেই তো বোধহয় স্বচ্ছতা কে বিদায় দেওয়া'! সে সাংসারিক জীবনেই হোক বা কর্মজীবনেই হোক। সে যাই হোক, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে আমি যদিও প্রতিষ্ঠিত তবে আহামরি কিছু নয়। অনেকটা দশটা পাঁচটার সরকারি চাকরী আর কি। যদিও নামের পাশে একটা গালভরা ডেসিগনেসন্ আছে, তবে রুটিনমাফিক কাজই করতে হয়, যার মধ্যে ক্লারিকাল কাজও থাকে। তাই অঞ্চিত কে বলা 'শুনেছি ভালো প্রতিষ্ঠিত'র অনেকটাই অতিরঞ্জিত। না রে, honestly গবেষণার থেকে আমি এখন অনেক দূরে। গবেষণা আর করি না বললেই বোধহয় সত্য বলা হবে। তবে আমার গবেষণার খোঁজ নেওয়াতে একই সাথে আনন্দিত ও বিস্মিত হলাম। তোর মনে আছে প্রথম বিদেশে কনফারেন্সে গবেষণাপত্র পড়ে আসার পর তুই জিজ্ঞেস করেছিলি কোনো টাকা দিয়েছে কিনা! স্বপ্নাভ আই.টি পাশ করে বিদেশে গিয়ে ততদিনে গাড়ি কিনে ফেলেছে - সেটাও বলেছিলি। স্মৃতিরাও সময়ে সময়ে এত অবাধ্য হয়ে যায় যে... হ্যাঁ, স্বপ্নাভ'র সাথে যোগাযোগ আছে। ও এখন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। পরে ও MBA করেছিলো। যথা অর্থে প্রতিষ্ঠিত।
ভ্রু-পল্লবে কেউ ডাক দেয় নি, তাই চন্দনের বনে আর যাওয়া হয়নি। তোর কৌতূহল নিরসনের জন্য বলি আমাদের দেখেশুনে বিয়ে, সোজা কথায় যাকে বলে অ্যারেন্জড্ ম্যারেজ। বিড়ালের ভাগ্যে শেষপর্যন্ত শিকে ছিঁড়েছিল! সেবার যখন বন্যার পর বাড়ি গেলাম, তোর সাথে দেখা করতে গেছিলাম। মনে আছে অনেকক্ষণ আড্ডা ও তর্ক হয়েছিলো? তুই আমাকে বুঝিয়েছিলিস যে মেয়েরা কখনো ভালোবেসে কাউকে বিয়ে করে না, নিরাপত্তাহীনতা থেকে বিয়ে করে। সেদিন ভালো বুঝতে পারিনি তোর কথার অর্থ, আজও যে ভালো বুঝি তাও নয়। তবে কোথাও একটা খটকা লাগে। এক মহিলা সহকর্মীকে দেখেছি যাঁর মাইনেপত্তর বেশ ভালো মানে নিরাপত্তাহীন নয়। তবুও বিয়ের জন্য শুনেছি তিনি দু'তিনজন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাই ভাবি মেয়েদের বিয়ের কারণ কি নিরাপত্তাহীনতা হতে পারে? আমার মনে হয় তুই সেদিন যেটা বলতে পারিসনি সেটা হল মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হতে বিয়ে করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ তো এক একটি মেয়ের কাছে একেক রকম! সে যাই হোক, অঞ্চিত ঠিকই বলেছে তোকে যে আমি বিয়ে করার বছর চারেক পরই চাকরি টা পেয়েছি। আর চাকরি সূত্রেই প্রবাসে পাড়ি। ফিরে যেতে পারবো কিনা নিজেই জানি না তাই ফেরার প্ল্যানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আনপ্ল্যানড্ লোকের জীবনে আবার প্ল্যান!
'How many roads must a man walk down / Before you call him a man?'
বব ডিলান এখনো আমার প্রেরণা। গান লিখেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি একমাত্র ওঁনার ঝুলিতেই, যাঁর গান আবার নাগরিক অধিকার ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের ভাষা (anthem)।নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে ডিলান সাহেব সম্ভবতঃ 'most radical choice'। শুধু ভাবি কি পরিমান কলমের ধার থাকলে সুইডিশ অ্যাকাডেমিও সাহিত্যের সীমানা কে রিডিফাইন করতে বাধ্য হয়।
না রে, আবৃত্তির সাথে বহুদিন হলো আড়ি। কালে ভদ্রে হয়তো শখে করি। হ্যাঁ, কবিতা পড়তে এখনো ভালোবাসি, তবে পড়া আর বিশেষ হয়না আজকাল। কারণ বই পাওয়ার একটা অসুবিধে আছে এখানে। অঞ্চিতের কাছে তোর নতুন ফ্ল্যাট কেনার কথা জানলাম। তোর মনে আছে শেষবার যেদিন আমাদের বাড়ি এলি, অতীনের ফ্ল্যাট কেনার খবর শুনে তুই বলেছিলিস যে ফ্ল্যাট তোর একদমই পছন্দ নয় কারণ ফ্ল্যাটে তোর মাথার ওপরের ছাদ টা আরেকজনের মেঝে আর তোর মেঝে টা আরেকজনের মাথার ওপর ছাদ। নিজের ঘরকেও অন্য কারোর সাথে ভাগ করে নেওয়া কখনোই তুই মানতে পারিস না! তোর চিন্তার মৌলিকতা ভাবিয়েছিল সেদিন। সেটাই বোধহয় আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল, তাই না? মনে আছে সেদিন আরো অনেক প্রসঙ্গ তুলেছিলিস যার উত্তর সেদিন আমার কাছে ছিল না। আজ হয়তো উত্তর আছে কিন্তু বলার মন নেই বা মাঝ বয়সের সংস্কৃতিতে আটকায়। ডিলান সাহেবের কথায় বলি "The answer, my friend, is blowin' in the wind... "। সেদিন 'নীরা হারিয়ে যেওনা' শোনানোর পর তুই বলেছিলিস 'আমার সম্পূর্ন আবেগ শুধু মোমবাতির আলোর মত ভদ্র ও হিম'। কোনো কিছুতেই কোনোদিন সোচ্চার দাবিদার ছিলাম না, আজও একই রকম।

পরিবর্তন কি কি হয়েছে সেটা অন্যরা বোধহয় ভালো বলতে পারবে। তবে মাথার চুল অনেক পেকে গেছে। Greying gracefully! চেনা ব্যস্ততা আর অচেনা আপোষের সাথে জীবন তার পার্থিব ছন্দে বয়ে চলেছে। হ্যাঁ, আপোষ বা সমঝোতার সাথে এখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মধ্যবিত্ত বিবাহিত ছেলেদের সাংসারিক জীবন এবং কর্মজীবনের বাইরে আর কিছু থাকে না রে। তাই আপোষ করাটাও জীবনের একটা অংশ এখন। নাহলে চাকরি টা ছাড়তে হয়। সেই সাহস তো আমার নেই... 'এই বেশ ভালো আছি' করেই দিব্যি চলে যাচ্ছে। দেশের বাড়ি প্রতি বছরই যাই, অন্তত একবার হলেও। মা না থাকলেও মাটির টান এখনো আছে। মানুষের কথা না বলাই ভালো। এই আর কি। সুনীলের দুটো লাইন দিয়েই শেষ করি।

'ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে... হৃদয় উন্মুক্ত ছিল, তবুও হৃদয় ভরা এমন প্রবাস!... ' ভালো থাকিস। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছিলাম যে আফটার শেভ লোশনের নেশা এখনো আমার আছে। ইতি, উজান
পুনশ্চঃ সব চরিত্র ও ঘটনাবলী কাল্পনিক।
সুমন সিনহা 
১১/১২/২০২০

No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...