Sunday, April 25, 2021

পর্ব ১

যা দেখি যা শুনি একা একা কথা বলি... 

Prologue 

আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক নিয়মেই আমরা একে অপরের সাথে কথা বলি, মেলামেশা করি। সময়ের সাথে সাথে কারোর কারোর সাথে বেশি বন্ধুত্ব হয়, বেশী যোগাযোগ থাকে, আবার কারোর কারোর সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। কারোর কারোর সাথে শুধু সৌজন্যের সম্পর্ক থাকে, কারোর কারোর সাথে শুধুই পেশাগত সম্পর্ক থাকে। সম্পর্ক যে ধরণেরই হোক না কেনো, প্রত্যেক টা সম্পর্কেরই একটা অর্থ আছে বলে আমি মনে করি, অন্ততঃ থাকা উচিৎ। সে কারণেই আমরা একে অপরের খবর নিই, একে অপরের সাথে কথা বলি ইত্যাদি। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা, গল্প, তর্ক, যুক্তি, প্রতিযুক্তি, মতবিনিময়, আলাপচারিতা সবকিছুই হয়। সেখান থেকে কত কিছু জানা যায়, শেখা যায়, বোঝা যায়। কতজন কে নতুন ভাবে চেনা যায়। পরে যখন সেগুলো নিয়ে ভাবি, তখন একটা মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কখনো ভালো লাগার, কখনো খারাপ লাগার। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু বছর ধরে দেখছি ভালো লাগা বা খারাপ লাগা কোনো অনুভূতিই আর বিশেষ হচ্ছে না। তার জায়গায় হতাশ লাগছে, নিরাশ লাগছে আর ক্রমশঃ যেনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি অন্যদের থেকে। আরো একা হয়ে পড়ছি। শুধু যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা কথোপকথন থেকেই নিরাশ বোধ করছি তা না, চারপাশে ঘটে চলা সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, সংবাদ মাধ্যমে সেগুলোকে দেখানোর ধরণধারণ, ব্যক্তিগত জীবনে ও সামাজিক মাধ্যমে সেসব ঘটনার প্রতি পরিচিত, আধা - পরিচিত ও অপরিচিত লোকজনের প্রতিক্রিয়া - এসব কিছুই বড় প্রভাবিত করেছে ও করে।
সেই সব অনুভূতি গুলোকেই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি এখানে। কোনোরকম তিক্ততায় আমি বিশ্বাসী নই। "মানুষ বদলায়, তাই সে সুন্দর" - এই বিশ্বাসকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই।
-------------------------------------------------------------------------
পর্ব ১

প্রায় অনেক বছর ধরেই শুনে আসছি পশ্চিমবঙ্গে আর কিছুই নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ একটি অপয়া সংখ্যা কারণ পশ্চিমবঙ্গের যা কিছু খারাপ তা ঐ ৩৪ এর জন্যই। মিডিয়া, কিছু রাজনৈতিক দল ও নির্লজ্জ সুবিধাবাদী বেশকিছু ভদ্র মহোদয় মহোদয়াগণ প্রচার ও প্রোপাগান্ডায় ৩৪ কে এমন একটা ফাইন আর্টসের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে তার আগের ৩০ বা পরের ১০ বছরেও যে একটা পশ্চিমবঙ্গ ছিল, সেটাই অনেকে ভুলে গেছেন। একটা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কুৎসা, মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র করতে করতে সবাই একটা জাতির কথা বেমালুম ভুলে গেলো! এবারে বিধানসভা নির্বাচনের আগে অভূতপূর্ব প্রচার যে বাংলায় ভোটার ছাড়া আর কিছুই নেই! একটা দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে নিয়ে আবার টানাপোড়েন আর তাতে সবচেয়ে বেশি সামিল বাঙালি মিডিয়া! এর পেছনে উদ্দেশ্য বা কারণ জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা বিচার বিশ্লেষণ করবেন। কিন্তু এই যে পশ্চিমবঙ্গে আর কিছু নেই, এই "কিছু" টা কি কি? কর্মসূত্রে বাংলার বাইরে থাকি বলে এই "কিছু"র একটু আন্দাজ পেয়েছি যেমন 'বাংলায় কি আছে আর?', 'বাঙালিরা কি কাজ করে?', 'বাঙালি রা কিন্তু খুব ফাঁকিবাজ', 'ওখানে তো সরকারি চাকরি বাকরি আর কিছুই নেই', 'বাঙালিরা তো সবাই এখন বাংলার বাইরে' ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু প্রবাসী বাঙালিকেও আমি এগুলো বলতে শুনেছি। বাংলা ছেড়ে বাঙালিরা বাংলার বাইরে এটা বাজারে খুব চলে। এই ব্যাপার টা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে আমার। প্রথমে এই ব্যাপার টা একটু দেখা যাক।

প্রত্যেক টা রাজ্যেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, মূলতঃ সেটা জাতিগত স্বাতন্ত্র্য যা সেই রাজ্যের অধিবাসীদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও যাপন নির্ধারণ করে। পশ্চিমবঙ্গকে অন্য রাজ্যের সাথে তুলনা করতে গেলে এই স্বাতন্ত্র্যের কথাটি সবসময় মাথায় রাখতে হবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের ছেলে মেয়েদের একাডেমিকস্-এ থাকার প্রবণতা সবসময়ই বেশি। তার একটা কারণ বাংলায় সরকারি বা সরকার অনুমোদিত স্কুল কলেজের সংখ্যা অন্য রাজ্যের থেকে অনেক বেশি। স্বভাবতই, বাঙালি ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার প্রতি ঝোঁক অনেক বেশি। দেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (পশ্চিমবঙ্গ সহ) গুলোর দিকে নজর দিলেই সেটা খুব পরিষ্কার বোঝা যায়। এখন এই সমস্ত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোতেও তো শিক্ষক, শিক্ষিকা, বিজ্ঞানী পদে নিয়োগ হয়। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় যদি বাঙালি ছেলেমেয়েরা সেসব পদে নির্বাচিত হয়, তাহলে তো সেটা গর্বের। নাকি তারা সেসব চাকরি করবে না যেহেতু লোকজন বলবে বাংলা ছেড়ে বাঙালিরা বাইরে? আরো একটা ব্যাপার ভাবতে হবে। উচ্চশিক্ষা মানেই কিন্তু নির্দিষ্ট থেকে নির্দিষ্টতর বিষয়ে পড়াশোনা করা। ধরুন কেউ কোনো বিষয়ে পিএইচডি করে সেই বিষয়ের ওপরে আরো গবেষণা করতে পোষ্টডক্টরেট স্তরে পড়াশোনা করলো। দেশে বা বিদেশে কোথাওই হতে পারে। এখন তিনি এমন কোনো বিষয়ে গবেষণা করেছেন যে বিষয়ের ওপর কাজ দেশের হাতেগোনা দু একটি প্রতিষ্ঠানে হয় এবং ঘটনাচক্রে পশ্চিমবঙ্গে সেই ধরণের প্রতিষ্ঠান নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবে তিনি চেষ্টা করবেন সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবার যেখানে তাঁর বিষয়ের ওপর কাজ হয়। এটাকে কি বাঙালি বাংলার বাইরে চলে যাচ্ছে হিসেবে ব্যাখ্যা করা টা যুক্তিসঙ্গত? আবার অনেকের ব্যাক্তিগত ইচ্ছে বা স্বপ্ন থাকে নির্দিষ্ট কোনও প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে, সে দেশেই হোক বা বিদেশে। তিনি যদি তাতে সক্ষম হোন, সেটা আনন্দের ও প্রেরণার এবং বাঙালি হিসেবে গর্বের। বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে কেউ থাকলে ব্রেনড্রেন হয়ে গেলো বা দেশের কি লাভ হল বলে হাহুতাস, আর দেশে ফিরে এলে বাংলার বাইরে বলে আহা উহু। কি কিউট একটা ব্যাপার!

এবার উচ্চশিক্ষার কথা ছেড়ে অন্য ক্ষেত্র গুলো একটু দেখা যাক। ভারত একটা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ যার একটি ফেডারেল গঠন আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদে বিভিন্ন রকম চাকরির জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করা যায় ও সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার (বা ইন্টারভিউ) মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচন করা হয়। সেটা কোনো অ্যাকাডেমিক ইন্সটিটিউট হতে পারে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে বা কোনো বিভাগ বা কোনো দপ্তর বা সাব অর্ডিনেট অফিস হতে পারে। যে কোনো রাজ্যের প্রার্থীরা সেসব চাকরির জন্য আবেদন করতে পারে ও অনেক ক্ষেত্রে সেইসব চাকরির পূর্বশর্ত হয় যে নির্বাচিত হলে ভারতের যে কোনও রাজ্যে প্রার্থী কে চাকরিসূত্রে থাকতে হতে পারে। এমনও সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যা ভারতবর্ষের মধ্যে একটি মাত্র রাজ্যেই আছে। আর শুধু কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি নয়, বিভিন্ন পাবলিক সেক্টর কোম্পানি বা প্রাইভেট কোম্পানি আছে যারা সর্বভারতীয় ভাবে নিয়োগ করে। পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের বাইরে যে বাঙালি ছেলেমেয়েরা সেসব চাকরিতে আবেদন করবে না? তাদের নির্বাচিত হয়ে চাকরি করা টা কি 'বাঙালি বাংলা ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে' বলা যায়? অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা নির্দিষ্ট কোনো পাবলিক সেক্টর বা প্রাইভেট কোম্পানির সাথে যুক্ত হতে চায়। এরকম তো হয় যে কেন্দ্রীয় সরকারি বা পাবলিক সেক্টর বা প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি পেয়ে কারোর কারোর কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ। এমনিতেই ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বাঙালিদের উল্লেখযোগ্য ভাবে কম নির্বাচিত হওয়া নিয়ে (যদিও তার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে ধরা হয়) একটা আক্ষেপ আছেই। বাঙালি বাইরে না গেলে 'ঘরকুনো', আর বাইরে গেলে হায় হায় সব শেষ হয়ে গেলো!
আরো একটি ব্যাপার বলি। ধরুন কোনো বাঙালি ছেলে বা মেয়ে নতুন কোনো চাকরি পেয়ে বাংলার বাইরে কোথাও যোগ দিলো। তারপর সে বিয়ে-থাওয়া করলো। এখন তার সঙ্গীনি বা সঙ্গী টি যদি সেই শহরে চাকরির চেষ্টা করে বা পেয়ে যায়, সেটাই তো সাধারণ জ্ঞানে স্বাভাবিক। সেটা কি 'বাংলায় কিছুই নেই' হতে পারে? ব্যতিক্রম থাকতেই পারে কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না।

এবারে দেখা যাক 'ওখানে তো সরকারি চাকরি বাকরি আর কিছুই নেই' এর দিকে। বিগত দশ বছর বাদ দিলে কি কখনো পশ্চিমবঙ্গে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের বিভিন্ন পদে, পুলিশে, দমকলে, হাসপাতালের বিভিন্ন পদে নিয়মিত নিয়োগ বন্ধ ছিল? আর সেইসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কখনো লাগামছাড়া দুর্নীতি বা স্বজন পোষন বা ঘুষের অভিযোগ উঠেছিল? আবারো বলছি ব্যতিক্রম হয়তো কিছু ক্ষেত্রে ছিল (সেটা কখনোই কাম্য নয়), কিন্তু তাকে সাধারণীকরন করলে সত্যের অপলাপ হবে। আর অন্য রাজ্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করলে সেই রাজ্যের সরকারি চাকরির নিয়োগে বা স্কুল, কলেজে নিয়োগে কি হয় বা কি ভাবে হয় সেই ধারণা অবশ্যই রাখতে হবে।
'বাংলায় আর কিছুই নেই' এর মধ্যেও গতকাল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ARWU (Academic Ranking of World Universities) ranking এ প্রথম হয়েছে। গতবছর কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত ভারতের প্রথম দশটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যাদবপুর (তৃতীয় স্থান) ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (পঞ্চম স্থান) ছিল। দুটোই রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে খড়্গপুর আই আই টি (প্রথম স্থান ) ছিল যেটা পশ্চিমবঙ্গে। এখন বাঙালিরা যদি 'কাজই না করে' বা 'ফাঁকিবাজি' করে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠান গুলো চলছে কি করে বা চালাচ্ছে কারা? এই প্রতিষ্ঠান গুলো ছাড়াও অন্যান্য একাধিক অফিসে বা স্কুলে বা কলেজে বহু মানুষ সৎ ভাবে পরিশ্রম ও দক্ষতার সাথে কাজ করে চলেছে যা আড়ালেই থেকে যায়।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে 'বাংলায় আর কিছুই নেই, সব শেষ হয়ে গেছে' বলে যে তীব্র ও সচেতন প্রচার চালানো হচ্ছে, আমরাও যদি সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করি তাহলে বুঝতে হবে এই পোস্টট্রুথ পলিটিক্সের যুগে আমাদের ভালোই মগজধোলাই হয়েছে।

সুমন সিনহা 
০৩/০৪/২০২১

No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...