Saturday, April 24, 2021

যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া...

যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া...
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গোটা বিশ্ব এখন দিশেহারা। করোনার ছোবল থেকে আমাদের দেশও বাদ যায়নি। এক কোটি তিরিশ লাখ জনসংখ্যার একটি দেশে এই মহামারী বা অতিমারী কি রূপ নিতে পারে, সেটা এখন মোটামুটি সবার জানা হয়ে গেছে। সরকার lockdown ঘোষণা করেছে। সরকার কি করতে পারত বা কি কি করেনি এসব আলোচনার বাইরে গিয়ে আসুন এই অসময়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কিছু টুকরো টুকরো চিত্র তুলে ধরি। সাম্প্রতিক অতীতে মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যে ভারতবর্ষের ছবি দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে গেছি, করোনার দৌলতে এক অন্য ভারতের ছবি দেখবার চেষ্টা করি। করোনার বিরুদ্ধে ভারতবাসীর আপ্রাণ ও আপোষহীন লড়াইয়ের কিছু কোলাজ, দেশপ্রেমের কিছু নিদর্শন।
বহু ব্যক্তি এবং সংস্থা এই দুর্দশায় সরকারের বা বলা ভালো দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রচারের আলোর বৃত্তের বাইরে যে অসংখ্য, অগুণিত ভারতবাসী নানারকম ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কথা আজ না হয় একটু ভাবি।
যে সমস্ত ডাক্তার, নার্স, আয়া, সাফাইকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক ও সহকারী সহ স্বাস্থ্যকর্মীগণ দিনরাত সামনের সারিতে থেকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, কোনো শব্দই বোধহয় তাদের স্বীকৃতি দিতে যথেষ্ঠ নয়। আর যে সব ডাক্তার বা নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীগণ উপযুক্ত PPE বা মাস্ক না পেয়েও অক্লান্ত কাজ করে চলেছেন তাঁরা তো শুধু করোনার সাথেই লড়ছেন না, মৃত্যুর সাথেও লড়ছেন। বিশেষতঃ মহানগরীর হাসপাতাল গুলো বাদ দিয়ে গ্রামীণ বা ব্লক এমনকি জেলা হাসপাতাল গুলোর স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা একবার ভেবে দেখুন। ভাবার সময় ডাক্তার - রোগী অনুপাত টা একটু স্মরণে রাখবেন। এর সাথে যোগ হয়েছে ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরতে পারা পরিযায়ী শ্রমিক ও তার পরিবারের বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষা। তাঁদের এই নিরলস সংগ্রামের চিত্র আমাদের স্মৃতিতে যেনো ধূসর না হয়ে যায়। এরকম নয় যে করোনার জন্য অন্য সব রোগ বা অসুখ থেমে আছে। যেসব ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীগণ জরুরী অপারেশন বা চিকিৎসা করে যাচ্ছেন তাঁদের ভূমিকা কোনো অংশেই খাটো যেনো না করি। টিউবারকুলেসিস আমাদের দেশের একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা। করোনার প্রকোপে সেটা একটুও কমে যায়নি কিন্তু। lockdown এর এই আকালেও যারা রক্তের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বা রোগীদের কাছে রক্ত পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁরাও যোদ্ধা। lockdown এ প্রসব আটকে নেই বা থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তের প্রয়োজনও থেমে নেই। ভারতবর্ষে প্রসবোত্তর অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া প্রসূতি মায়েদের সংখ্যা নেহাতই কম নয় কিন্তু। না, শুধুমাত্র স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত মানুষদের নিয়ে আমাদের এই দেশ নয়। আসুন এবার অন্য কিছু ছবি দেখার চেষ্টা করি।

অসংখ্য বয়স্ক সহনাগরিক আজ ঘরবন্দী। তাঁরা একা এবং বাইরে বেরোনো তাঁদের পক্ষে কার্যত সম্ভব নয়। এই সময়ে যে বা যাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপত্তর পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁরাও কোভিডযোদ্ধা। গবাদি পশুদের নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করে যাচ্ছেন যাঁরা, অভুক্ত ফুটবাসীদের মুখে যাঁরা অন্ন তুলে দিচ্ছেন, পাড়ার ছোটো অথবা মাঝারি মুদিখানা দোকানগুলো খোলা রেখে যাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর যোগান চালু রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, ওষুধের দোকানগুলো খোলা রেখে যাঁরা আমাদের দরকারী ওষুধপত্তর সরবরাহ করে যাচ্ছেন, এঁরা সকলেই এই লড়াইয়ে সামিল। lockdown এ মহিলাদের ঋতুচক্র থেমে নেই। যে সব মহিলারা ঘরে ঘরে স্যানিটারী ন্যাপকিন পৌঁছে দিয়ে অসংখ্য মহিলাদের সাহায্য করে চলেছেন, তাঁরাও তো কোভিডযোদ্ধা। যে সাফাইকর্মীরা রাস্তাঘাট, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট আমাদের জন্য প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করে চলেছেন, যাঁরা খাদ্য গণপরিবন্টন ব্যবস্থার সাথে যুক্ত থেকে লড়াই করছেন তাঁরাও এই যুদ্ধে সামিল। জল জঙ্গল পেরিয়ে যাঁরা আদিবাসীদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন, যে সব পুলিশকর্মী দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে মানবিকতার নজির রেখে চলেছে এই পরিস্থিতিতে, তাঁরা সবাই এই যুদ্ধের সাথী।
এরকম আরো অনেক অনেক ছবি আছে আমাদের চারপাশে। আর এই সব ছবির চরিত্রগুলো আমার, আপনার সবার কমবেশি পরিচিত বা অপরিচিত। বিশ্বাস করুন এদের নিয়েই আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষ, এরা সবাই ভারতীয়। এই বিপর্যয়ে এদের লড়াই আমাদেরই লড়াই, লড়াইয়ের ঘামে ভেজা এদের জামা আমাদেরই জামা। সিয়াচেনের - 35° C তাপমাত্রার গল্প বা দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো'র চিৎকার চেঁচামেচি এঁদের লড়াই কে থামাতে পারে না।
হঠাৎ এই অপরিকল্পিত lockdown এর প্রভাব এসে পড়েছে অসংঘটিত ক্ষেত্রের অগুন্তি পরিযায়ী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ওপর। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বোধহয় এরাই। বিভিন্ন জাতীয় বা রাজ্য সড়ক বা অন্যান্য রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যাঁরা এদের হাতে বিস্কুট, জল, মুড়ি, ফলমূল ও অন্যান্য খাবারদাবার তুলে দিচ্ছে, তাঁদের এই আন্তরিক প্রয়াস আমাদের দেশেরই একটা চিত্র। ভারতেরই কোনো জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে যখন কোনো জনৈক রামবাবু কে তারই কোনো সহনাগরিক ফিরোজ বসিয়ে খাওয়ায় বা কোনো হিন্দু প্রৌঢ়ের সৎকারে যখন একদল মুসলিম কাঁধে করে তাঁকে 'রাম নাম সত্য হ্যায়' বলে শ্মশানে নিয়ে যায়, তখন চিরাচরিত ভারতের একটা অখণ্ড ছবিই ধরা পড়ে। বা ধরুন ভিন রাজ্য থেকে ফিরে আসা যে শ্রমিক রা নিজেদের পরিবার ও গ্রাম কে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে গাছের ওপর নিজেদের কে কোয়ারান্টাইন করে রাখে, তাদের কে কি বলবেন? পরিবার ও দেশ কে ভালো না বাসলে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে এরকম করা যায় কি? অন্ততঃ যে সব আহাম্মক বা তাদের বাড়ির লোক বিদেশ থেকে ফিরে শপিং মল, অনুষ্ঠান বাড়ি, মন্দির, মসজিদ, বাজার ঘুরে বেরিয়ে যে সীমাহীন কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের থেকে এই প্রান্তিক, চাহিদাহীন মানুষগুলো অনেক বেশী সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করছে। রাষ্ট্র দায়হীন হলেও এরা কিন্তু দায় এড়িয়ে যায় নি। বা ধরুন যে দিনমজুর টি তার স্ত্রীর পা ভেঙে যাওয়াতে কাঁধে করে স্ত্রী কে নিয়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাঁর এই হিসেবহীন প্রেম ইতিহাসের পাতায় কোনোদিন স্থান পাবে না। কিন্তু তিনিও কি কোভিডযোদ্ধা নন? অথবা হাজারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যে উজবুকের দল কে মসজিদে নামাজ পড়া থেকে বিরত রাখতে যে সব মৌলবী লাঠি হাতে মসজিদ পাহাড়া দেয়, সেও তো ভারতবর্ষেরই একটা ছবি।
আপনার মতোই আমিও আশাবাদী। খুব তাড়াতাড়ি এই লড়াইয়ে আমরা জয়ী হব, হবই। শুধু অনুরোধ, তারপর যেনো নাম-না-জানা আমাদের এই সহনাগরিক সহযোদ্ধারা আমার, আপনার বিস্মৃতির আড়ালে না চলে যায়।
ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। জয় হিন্দ।

সুমন সিনহা 
৩০/০৩/২০২০

No comments:

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...