Sunday, April 18, 2021

ভ্যালেন্টাইনস দিবস

"ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো

প্রেমের পদ্যটাই

বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি

শুধু তোমাকেই চাই।"

ভ্যালেন্টাইনস দিবসের উৎস নিয়ে নানারকম মতবাদ প্রচলিত আছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হল যে প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া উৎসব কালের নিয়মে বিবর্তিত হয়ে আজকের ভ্যালেন্টাইনস দিবস। এই উৎসব ফেব্রুয়ারির ১৩-১৫ তারিখ পর্যন্ত পালিত হতো এবং রোমের প্রাচীন দেবী লুপারকাসের নাম থেকেই এই উৎসবের নামকরণ হয় বলে ধরে নেওয়া হয়। রোমের মানুষ যখন প্রবলহারে খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল, লুপারকালিয়া উৎসব কে তারা মেনে নিতে পারছিল না, কিন্তু উৎসবটির জনপ্রিয়তাও অস্বীকার করতে পারছিল না। শেষপর্যন্ত এই উৎসবটিকে তারা সন্ত ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গ করে। ইনি হলেন সেই সন্ত ভ্যালেন্টাইন, খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তৃতীয় শতকে যার গর্দান কেটেছিলেন।

লুপারকালিয়া উৎসব ছিল সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক একটি উৎসব। নারীদের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একসাথে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় নারীদের প্রহার করে সঙ্গমের জন্য নিজের পছন্দমত সঙ্গিনী বেছে নেওয়ার উৎসব ছিল লুপারকালিয়া। আর যাই হোক, এরকম একটি নির্মম উৎসবের সাথে কোনোভাবেই প্রেম বা ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।

মধ্যযুগের ইংরেজি কবি চশার ও পরবর্তীতে শেক্সপীয়ার এই ভ্যালেন্টাইনস দিবস কে নিয়ে কবিতা বা কাব্য লেখেন ও এটিকে রোমান্টিক দিন বলেন। চশার যদি ভ্যালেন্টাইনস দিবস কে রোমান্টিক আখ্যা না দিতেন এবং কাব্য না করতেন তাহলে হয়তো এই দিনটির সাথে ভালোবাসা এসে মিশতো না এবং নারীদের ওপর নির্যাতন করার প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক উৎসবের দিনটি প্রেমের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতো না। এমন কি যে দুজন ভ্যালেন্টাইন সন্ত কে মেরে ফেলা হয়েছিল মধ্য ফেব্রুয়ারিতে, তারা যে খুব রোমান্টিক ছিলেন এমন তথ্যও পাওয়া যায় না।

যাইহোক এই শতাব্দীতেও সেই ভ্যালেন্টাইনের নামে এই দিনটি পালন করা হচ্ছে এবং বিবর্তিত বা পরিবর্তিত হতে হতে এই দিনটি এখন মূলতঃ 'commercial celebration of romance'এই দিনটি এখন ব্যবসায়ীদের জন্য বড়দিন। শোনা যায় শুধুমাত্র আমেরিকায় ভ্যালেন্টাইন দিবস উপলক্ষে ২০১৮ সালে ১৭.৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৯ সালে ১৮.২ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা (উপহার ও ডিনার নিয়ে) হয়েছিলো।

ভ্যালেন্টাইনস দিবসের উৎস যতো কুৎসিতই হোক বা ব্যবসায়ীরা যতোই ব্যবসা করুক না কেন এই দিনটিকে নিয়ে, বর্তমান সময়ে কোনো ভাবে এই দিনটির সাথে ভালোবাসা বা প্রেম শব্দটি জড়িয়ে গেছে। সম্ভবত চশারের জন্যই ধরা হয়ে থাকে। চারিদিকে যখন হিংসা, ঘৃণা, অবিশ্বাস আর স্বার্থপরতা, তখন যদি মানুষ কোনো এক নামে কোনো এক দিনে ভালোবাসা বা প্রেমের চর্চা করে, করুক না। ক্ষতি কি? আদিকাল থেকে বিবর্তন হতে হতে মানুষ তো আজ শুধু প্রেমিক - প্রেমিকা কে নয়, বাবা, মা, ভাই, বোন বা প্রিয়জনকেও 'হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন' শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।

যে সব মৌলবাদীরা এই দিনটির উদযাপন আমাদের সংস্কৃতিবিরোধী বলে মনে করছে, সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়। প্রেম বা ভালোবাসা তো যেকোনো সংস্কৃতির অংশ!

আমি কখনোই বিশ্বাস করি না যে ভালোবাসা কোনো একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ভালোবাসার নামে দামী উপহার দেওয়া বা আদিখ্যেতাও একদমই পছন্দ নয় আমার। কিন্তু প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে আমাদের সমাজে যে একটা জড়তা আছে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাই মানুষ যদি আনুষ্ঠানিক ভাবে একদিন প্রকাশ্যে ভালোবাসা ব্যক্ত করে, সেই জড়তা কেটে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। প্রেম করা যে মন্দ নয়, চুমু খাওয়া যে নিষিদ্ধ নয়, সেই দ্বিধাও হয়তো দূর হবে ধীরে ধীরে। এটা ঠিক যে এই দিনটির সাথে ব্যবসাও জড়িয়ে গেছে। ভালোবাসার সাথে ব্যবসা না জড়ালেই ভালো হতো বোধহয়। কিন্তু শুধু ব্যবসায়িক দিকটি না দেখে কোনো পুরুষ যদি "সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থেকে" বা "ভ্রুপল্লবে ডাকে"র আশায় "চন্দনের বনে" যাওয়ার অপেক্ষায় ভালোবাসা প্রকাশ করে বা কোনো নারী যদি "শহীদ মিনারের ওপর থেকে চিৎকার" করে জানান দেয় "ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক", তার থেকে ভালো আর কি হতে পারে।

ভালোবাসা বা প্রেমের উদযাপন মানেই হিংসা বন্ধ হওয়া। ভ্যালেন্টাইনস দিবসে যদি হিংসা বন্ধ না হয়, তাহলে এই দিনের কোনো তাৎপর্য থাকে না। হিংসা বা ঘৃণা, সে যে ফর্মেই হোক,  দূর হয়ে যাক। পুলওয়ামা বা অনুরূপ কোনো ঘটনা যেনো আর আমাদের দেখতে না হয়। সকল শ্রেণীর মহিলাদের ওপর যে কোনো ধরণের নির্যাতন বন্ধ হোক।

"তুমি ভালোবাসতে না পারো, অন্তত ঘৃণা করো না

তুমি ফুল দিতে না পারো, অন্তত কাঁটা দিও না

তুমি চুমু খেতে না পারো, অন্তত চড় মেরো না।"

অবলোকনের তাৎক্ষণিকতায় নয়, উপহারের ওজনে নয়, দেখনদারির আদিখ্যেতায় নয়, ঘৃনার চাষে নয়, হিংসার উল্লাসে নয়, নির্যাতনের পৌরুষে নয়, অনুভূতির গভীরতায় এ পৃথিবী ভালোবাসাময়, প্রেমময় হয়ে উঠুক। আজকের দিনে এটুকুই চাওয়া।


সুমন সিনহা
১৪/০২/২০২১

ছবি: আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত 



 

3 comments:

Subhamoy Ghosh said...

Very good article.

Suman Sinha said...

Thank you Subhamoy da

Unknown said...

Valentine's day এর তাৎপর্য সুন্দর করে তুলে ধরায় অনেক অজানা কাহিনী জানতে পারলাম। সমগ্র বিশ্ব এই দিনটি কে প্রেম দিবস হিসেবে উন্মাদনার সাথে উদযাপন করে থাকে, আমাদের কামনা এই প্রেম প্রীতি ভালোবাসা সকলের মধ্যেই জাগরিত হোক ।লেখাটা খুব ভালো লাগলো, এই রকম লিখতে থাকো, অভিনন্দন

এলোমেলো ভাবনা - ১২

আজ  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সুনীল বাবুর উপন্যাস, কবিতা বা ইতিহাসধর্মী লেখালেখি অল্পস্বল্প যেটুকু পড়েছি, ভেবেছিলাম সেসব নিয়েই "অন...